আবরারের জন্য কাঁদছে পুরো দেশ

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ৮ অক্টোবর ২০১৯, ৪:৪২ পূর্বাহ্ণ

সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মেধাবী ছাত্র আবরারের মৃত্যুতে যেন প্রকৃতিও কাঁদছে। কাঁদছে পুরো দেশ। ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে পানি জমেছে। বৃষ্টিতে ভিজে বন্ধুর নিথর দেহের জন্য মর্গের সামনে অপেক্ষা করছেন বেশ কয়েকজন। তাদের কেউ ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থী কেউ বুয়েট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মর্গের সামনে আবরারের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। মামাতো ভাই জহিরুল ইসলাম প্রিয় ভাইটিকে হারিয়ে যেন বাকরুদ্ধ।

কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছেন। আবরারের মৃতদেহ নিয়ে আসা পুলিশ সদস্যদের চোখেও যেন একরাশ প্রশ্ন? নিষ্পাপ মুখটিকে কারা, কি কারণে হত্যা করলো। এসময় দুঃখ প্রকাশ করেন সিআইডি’র ক্রাইম সিনের এক সদস্য। বলেন, ছেলেটির মা-বাবা কতো বড়ই না একটি সম্পদ হারালেন। সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বন্ধুদের একটিই কথা, তার সঙ্গে এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। আবরারের মামাতো ভাই মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, আমি সকাল সোয়া ৫টার দিকে ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছি। তখন মামা (আবরারের বাবা) আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল থেকে ফোন দিয়েছে। ফাহাদ (আবরার) এখন জরুরি বিভাগে আছে। হাসপাতাল থেকে বলেছে আত্মীয় স্বজন কাউকে যেতে। ওর মামা-কাকাদের কাউকে ফোনে পাচ্ছি না। তুমি একটু হাসপাতালে যাও’। মামার কাছ থেকে নাম্বারটা নিয়ে ফোন দিলে আমাকে জরুরি বিভাগে যেতে বলে। হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের ভর্তি তালিকা পরীক্ষা করে আবরারের নাম পাইনি। ইতোমধ্যে পুলিশের একটি গাড়ি এসে থামলে পায়ের আঙ্গুল দেখেই চিনতে পারি যে ও আমার মামাতো ভাই। পরবর্তীতে ওর গায়ের চাদরটি উল্টে দেখি ওর হাতে, পায়ে মারের চিহ্ন।

আবরার কখনো কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল না। ওর পিঠে, পায়ে এবং হাতে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। ও এতো ভালো ছেলে ছিল যে কখনো কারো সঙ্গে উচু স্বরে কথা বলেনি। সে ছোট বেলা থেকে শান্ত স্বভাবের। এবং মেধাবী। কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়েছিল। সেখান থেকে সে ঢাকা মেডিকেলে চান্স পায়। কিন্তু মেডিকেলে পড়তে চায়নি। কারণ তার ইচ্ছা ছিল বুয়েটে পড়ার। পরবর্তীতে সে বুয়েটে ভর্তি হয়। তার হলের সহপাঠি এবং রুমমেটরা জানিয়েছে, রাতে তাকে ডেকে নিয়ে গেছে। এবং পরবর্তীতে হলের কোনো একটি রুমে তাকে বেদম পিটানো হয়েছে। তাকে কেনো মারা হয়েছে সেটা আমরা বলতে পারবো না। আবরারের বন্ধুর বাবা শ্যামল হক জোয়ার্দার বলেন, আমার ছেলে আর আবরারের ছোট ভাই একসঙ্গে ঢাকা কলেজে পড়ে। এবং তারা দুজন একই রুমে থাকে। আবরার ওদের বড় ভাইয়ের মতো দায়িত্ব পালন করতো। সকাল (সোমবার) পৌনে ৭টায় আমি হাঁটতে বেরিয়েছি। এ সময় ছেলে ফোন দিয়ে বলে, ‘আব্বু, ভাইয়া (আবরার) মারা গেছে। ফেসবুকে দেখে আমি আবরারের ছোট ভাইকে ফোন দিয়েছি। তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে’। তখন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। সে ছিল অত্যন্ত ভদ্র ছেলে। সে কিভাবে মারা গেলো। ওর তো কোনো শত্রু থাকার কথা না।

বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং আবরারের ক্লাসমেট বলেন, আমি আহসানউল্লাহ হলে থাকি। আবরার থাকতো শেরেবাংলা হলে। পুজার ছুটি শেষে কুষ্টিয়া থেকে গত রোববার বিকাল ৫টায় সে হলে পৌঁছায়। রাতে তাকে শেরেবাংলা হলের কয়েকজন শিক্ষার্থী ডেকে নিয়ে যায়। ওকে অনেক মেরেছে তারা। ভোর রাত ৪টায় আমি খবর পাই শেরেবাংলা হল থেকে একটি ছেলেকে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে খোঁজ করে দেখি যে সে ফাহাদ আবরার। এটা যে কেনো হলো। এবং তাকে কেনো এভাবে মারা হলো এটা অনুসন্ধান করা দরকার। ওর সঙ্গে এমনটা হওয়ার কথা না। ও সারাদিন পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কারো সঙ্গে টাইমপাস বা ঘোরাঘুরিতে নেই। আমরা একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি। কিভাবে এবং কেনো এমন হলো জানি না। আবরারের বন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী বলেন, আমরা একসঙ্গে নটরডেমে পড়েছি। পরবর্তীতে আবরার বুয়েটে চান্স পেয়ে যায় আমি ঢামেকে। ও ছিল অনেক বেশি স্টাডিয়াস (পড়ুয়া)। আমাদের সঙ্গে আড্ডা কম দিত। কিন্তু এমন না যে সে অসামাজিক। যে কোনো দরকারে ওকে পাশে পাওয়া যেত। আমাদের বিভাগ থেকে নটরডেমে ওর রেজাল্ট প্রথম বা দ্বিতীয়তে থাকতো। সে ধর্ম কর্ম এবং নামাজ রোজার বিষয়ে একটু সিরিয়াস ছিল। তবে ধর্ম নিয়ে বাস্তবিক জীবনে বা ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায়নি কখনো। যতদুর জানি ওদের হলে এই ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু সেগুলো লাইমলাইটে আসতে দেয়া হয় না। সামান্য কারণে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া। দাঁত ফেলে দেয়া। অমানবিকভাবে মারধর করা। এটা মূলত হলের ছাত্রদের দ্বারাই সংঘটিত হয়ে থাকে।

মাওলানা ভাসানী হলের সাবেক এক শিক্ষার্থী এবং ছাত্রনেতা বলেন, হলের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। অতি উৎসাহি কিছু ছাত্র আছে যারা লাইমলাইটে বা আলোচনায় আসতে চায়। এবং পদ পজিশন পেতে এটা করে থাকে। ছোট ছোট পদ যেমন সহ-সম্পাদক ইত্যাদি পদ পেতে এবং প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারির নজরে আসার জন্য এগুলো করে। এখানে হয়তো তাদের ইনটেনশন ছিল আবরারকে পিটানো। আবরারের বন্ধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, ওর মতো ছেলে হয় না। ওর সঙ্গে কারোর বিরোধ নেই। দ্বন্দ্ব ছিল না। আমরা একই স্কুলে সহপাঠি ছিলাম। সে সবসময় পড়া লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ওকে এভাবে মেরে ফেলা হলো কেনো জানিনা। ওর হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার চাই।

আরেক বন্ধু আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের বেশিরভাগ বন্ধুরাই এখন পুজার ছুটিতে কুষ্টিয়াতে আছে। আবরার গতকাল (সোমবার) বিকাল ৫টায় কুষ্টিয়া থেকে ছুটি কাটিয়ে ক্যাম্পাসে আসে। চলতি মাসের ২০ তারিখ তার পরীক্ষা। ওর সঙ্গে বুয়েটের কারো কোনো দ্বন্দ্ব ছিল বলে জানা নেই। এমনকি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেনি এমন কোনো কথা। তাছাড়া হলে ওর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কারণ আবরার এই টাইপের ছেলে না। ও এতোটাই রুটিন মেনে চলতো যে প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করতো। পড়ালেখার পাশাপাশি সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ রোজা নিয়মিত করতো। আমরা ওকে আড্ডা দিতে ডাকলে বলতো পড়া আছে। কারো আগে পিছে নেই সে। বন্ধু হিসেবে আমরা মজা করি। হাঁসি-ঠাট্টা করি। সে এসবের ধারে কাছে নেই। বর্তমান যুগের ছেলে হলেও সে ছিল অতি নম্র এবং ভদ্র। এদিকে, বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদের মৃত্যুর কারণ বলতে গিয়ে নৃশংস নির্যাতনের বর্ণনা ওঠে এসেছে চিকিৎসকের জবানিতে। আবরারের ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান বলেন, আঘাতগুলো দেখে মনে হয়েছে ভোঁতা কোনো কিছু দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছে। এটি বাঁশও হতে পারে বা ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প। তার শরীরে হাতে, পায়ে এবং পিঠে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...