বিরোধী দলের জাতীয় সংহতি রক্ষার ব্যর্থতার খেসারত দিচ্ছে জাতি

হারুন ইবনে শাহাদাত,

  • প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২০, ১১:৩৫ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন প্রতিটি মানুষই স্বদেশ চিন্তায় উদ্বিগ্ন। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে তারা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, স্বদেশের মঙ্গল চিন্তা করেন। দেশে বর্তমানে যে সরকার ব্যবস্থা চলছে, এই অবস্থার দায় কার? সরকার না বিরোধী দলের? তাদের এমন ভাবনার কারণ, তাদের কাক্সিক্ষত বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র তাদের প্রিয় জন্মভূমিতে অনুপস্থিত। তাদের এই সচেতন উপলব্ধি। অবশ্য তাদের এই উপলব্ধির সাথে রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাধারণ নাগরিক কারো মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। যদিও কিছু দলান্ধ চীনের একদলীয় ব্যবস্থার সাথে তুলনা করে বলেন, ‘ইহাও গণতন্ত্র।’ যেমন অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেনের ভাষায়, ‘গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করে যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে চিরতরে পরাজিত করি, তাহলেই এই দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটবে।’ কিন্তু এ কথা কারো অজানা নয়, গণতন্ত্র কোনদিন কাউকে চিরতরে পরাজিত কিংবা নির্মূল করার কথা বলে না, তা সমর্থনও করে না। এমন কুচিন্তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথেও সাংঘর্ষিক। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই মিশন নিয়েই সামনে হাঁটছে। তারপরও বিরোধী দলগুলো কেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এতটা পিছিয়েÑ কানাডাপ্রবাসী একজন পাঠক এই প্রতিবেদকের কাছে এমন প্রশ্ন রেখেছেন? যদিও দেশের অধিকাংশ নাগরিকের কাছেই এই প্রশ্নের উত্তর আছে। তারপরও অস্বীকার করার সুযোগ নেই, নিঃসন্দেহে এর উত্তর খুব সহজ নয়।

জাতীয় সংহতি রক্ষার ব্যর্থ বিরোধী দলগুলো :
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতীয় সংহতি রক্ষার ব্যর্থতার খেসারত দিচ্ছে বিরোধী দলগুলো। স্বৈরচারীশক্তি কোনোদিন চায় না, গণতন্ত্রের প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হোক। কারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে শত নির্যাতনেও তাদের দাবিয়ে রাখা যায় না। অবশ্য বিরোধী দলের নেতারা এই সত্য স্বীকার করতে চান না। তারা সরকারের ওপর দায় চাপিয়েই রুটিন কর্মসূচির মাধ্যমে দায় এড়ানোর পথে চলছেন। যে পথে হাজার বছরেও লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব নয়, যদি ঘটনার ঘনঘটায় প্রাকৃতিকভাবে কিছু না ঘটে। যা রাজনীতিতে কালেভদ্রে হাজারে একটি দুটি ঘটে। তাহলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে কীভাবে? এমন প্রশ্নে বিরোধী দলের নেতাদের এককথায় উত্তর, ‘সরকার স্বৈরাচারী’, ‘গণতন্ত্রের ধার ধারে না’, ‘কথায় কথায় রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে জুলুম-নির্যাতন চালায়, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূতভাবে মানুষ হত্যা করে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন অবস্থার মধ্যে তাদের টিকে থাকাই কঠিন। এখন প্রশ্ন হলো, একদিনেই কি এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে? অথবা দেশে কি এর আগে এর চেয়েও বড় কোনো স্বৈরশাসক আসেনি?

ইতিহাস কী বলে? অতীতের স্বৈরশাসকদের পরিণতি কী হয়েছে? উল্লেখিত প্রশ্নের উত্তর দেয়া আজকের এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়, কারণ এর উত্তর কমবেশি সবারই জানা। তারা এ কথাও জানেন, জনগণ জাগলে, গণতন্ত্রের পক্ষের সব শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার সুযোগ নেই। সরকারকে গণতন্ত্রের পথে রাখার দায়িত্ব বিরোধী দলেরও। জনগণের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সঠিক বার্তা বিরোধী দল পৌঁছানোর দায়িত্ব বিরোধী দলগুলোর। এক্ষেত্রে তারা সফল হলে কোনো সরকারেরই স্বৈরচারী আচরণ করার সুযোগ নেই। আর যদি কোনো সরকার জনমতকে উপেক্ষা করে নির্যাতনের পথ বেছে নেয়, তখন বিরোধী দলকে আন্দোলনের কৌশলও বদল করতে হয়। জনগণকে সাথে নিয়ে নতুন নতুন কৌশলে চালাতে হয় আন্দোলন-সংগ্রাম। কৌশল নির্ধারণী সভায় যদি সরকার পক্ষের কোনো এজেন্ট থাকে, তাহলে কোনো কৌশলই কাজে আসে না। কারণ কর্মসূচি গ্রহণের আগেই তা প্রতিপক্ষ জেনে যাবে এবং সেই অনুযায়ী প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেবে। তাই নীতি-আদর্শে নিষ্ঠাবান নেতা ও কর্মী বাহিনী ছাড়া আন্দোলন সফল হয় না। দেশে বর্তমানে রাজপথের বিরোধী দল হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বড় জোট বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও আদর্শের মিল আছে। এই জোটের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির পরেই জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থনের দিক থেকে এগিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এখন যারা সরকারে আছে তারা ভালো করেই জানেন, এই দুটি দলের ঐক্যে ফাটল ধরাতে না পারলে যে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের হারানো সম্ভব নয়। তাই তারা সবসময় এই দুই দলে বিভক্তি চেয়েছে এবং এখনো চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট বার বার তাদের সেই চাওয়া বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তারা এই ব্যর্থতার গ্লানি লাঘব করতে ভিন্ন নীলনকশা নিয়ে মাঠে নামে। তারা সফলও হয়েছে। তাদের এই সফলতার ফলেই বিরোধী দল বার বার ব্যর্থ হচ্ছে।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ, সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িকতার আধুনিক রঙিন বেলুন উড়িয়ে জাতীয় সংহতি ধ্বংস করার জাতিবিধ্বংসী ও নির্মূলের রাজনীতির শিকার আজ বিরোধী দলগুলো। এই বিভ্রান্তির গোলক ধাঁধায় বিরোধী জোট হেরে যাওয়ার কারণেই দেশবাসী আজ গণতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম বড় একটি দলের শীর্ষনেতাদের হত্যার আয়োজন বিরোধী দলগুলো নীবর দর্শকের মতো প্রত্যক্ষ করেছে। তারা ভুলে গিয়েছিল সরকার এরপর বসে থাকবে না। তাদের পালাও আসবে। এটি জাতীয় সংহতি বিনষ্টকারী একটি নীলনকশা। একসাথে সবাইকে ধরলে গোটা জাতি জেগে উঠবে, তখন এই নীলনকশার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি বিরোধী দলগুলো :
২০ দলীয় জোটের সামনে স্বাধীনতা-পরবর্তীতে সরকারের এমন আয়োজন ঠেকিয়ে দেয়ার মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ইতিহাস থাকার পরও তারা তা থেকে শিক্ষা নেয়নি। তারা সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যের শক্তি দেখাতে পারেনি। দেশের ও বিদেশের মিত্রদের সামনে অনাগত দিনের নির্মম চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সেই উত্তাল সময়ে মওলানা ভাসানী যা পেরেছিলেন, এই সময়ের বিরোধী দলগুলো তা পারেনি। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৩ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে দালাল আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে আলটিমেটামও দিয়েছিলেন। তাঁকে সমর্থন করেছিলেন ড. আলীম আল রাজী, অধ্যাপক আবুল ফজলসহ আরো অনেক প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী। ১৯৭২ সালের মার্চ থেকেই আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজলের মতো দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিদের ছেড়ে দেয়ার আবেদন ও দাবি উত্থিত হচ্ছিল। এককালীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এই সময় এক বিবৃতিতে জাতি পুনর্গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সমাধানের জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। হককথা, স্পোকম্যান, সাপ্তাহিক হলিডেসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকাও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক দলের শীর্ষনেতাদের নির্মূল আয়োজনের বিরুদ্ধে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সৈয়দ আবুল মকসুদ ও মরহুম শফিউল আলম প্রধান ছাড়া তেমন কাউকে দেখা যায়নি। ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বে থাকা সবচেয়ে বড় দল বিএনপি এক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তারা এর শেষ পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভাবেনি বা ভাবতে চায়নি। অথচ সরকারের এই নির্মূল অভিযানের সূত্র ধরেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আজ ‘পাকিস্তানি চর’ বলা হচ্ছে। তারও বিচার করতে চাচ্ছে। তাই আন্দোলনের মাঠে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে স্লোগান উঠলে তাদের শায়েস্তা করা সরকারের ‘পবিত্র’ দায়িত্ব এমন ভাবনার চাষ শুরু হয়েছে। অতএব আন্দোলন-সংগ্রাম আজ দুঃস্বপ্ন। কারণ ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’।

আরও যত ভুল :
রাজনীতির একটি ভুল কোনো ব্যক্তি, দল. এমনকি রাষ্ট্রকে হাজার বছর পিছিয়ে দেয়। তাই প্রতিটি রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করতে হয় খুবই সতর্কতার সাথে। এই সত্য আজ বিরোধী দলের কিছু কিছু নেতা উপলব্ধি করছেন। কিন্তু তাদের সেই আত্মসমালোচনার চেতনা সমর্থক ও জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আমাদের ভুলের খেসারত দেশের জনগণসহ বেগম খালেদা জিয়াকে দিতে হচ্ছে।’

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দলের নেতাদের কাছে জানতে চেয়েছেন- ড. কামাল হোসেন কবে জাতীয় নেতা ছিলেন? বিএনপির সাথে তাদের আদর্শে মিল কোথায়? তিনি কাকে তাঁর নেতা মানেন? তারা নেত্রীর কথায় লা-জবাব। কিন্তু আন্দোলন ও ভোটের পিঠে ছুরিকাঘাতকারীদের সাথেই আছেন এবং তাদের ব্যবস্থাপত্রই অনুসরণ করছেন। সে কারণেই জনগণের ভোটাধিকারও রক্ষা করতে ব্যর্থ আজ বিরোধী দল। ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ২৯ তারিখ রাতেই হয়েছে। কোটি কোটি ভোটার তাদের ভোটাধিকার হারিয়েছেন। বিএনপি শুধু ক্ষমতাই হারায়নি, হারিয়েছে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদাও। তারপরও রহস্যজনক কারণে ফলাফল ঘোষণার দিন দেশের কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়নি। সভ্য দুনিয়ায় এমন ঘটনায় জনগণ রাস্তায় নেমে পড়ে। নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় সরকার। কিন্তু নীরবে এমন করুণ পরিণতি মেনে নিয়েছে ২০ দলীয় জোট, যা আন্তর্জাতিক মিত্রদের কাছে ২০ দলীয় জোটের ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো বার্তা যায়নি। তাদের এমন আত্মহত্যার পিছনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা অন্য কেউ দায়ী, তার তদন্ত হওয়া জরুরি।

ভোটগ্রহণের কয়েকদিন আগে পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লাগামহীন বক্তৃতা দিয়ে ড. কামাল হোসেন পুরো বাহিনীকে ২০ দলীয় জোটের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুললেন। এমন ন্যূনতম রাজনৈতিক প্রজ্ঞাহীন ব্যক্তির ওপর ভর করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কতটা সফল হবে? যিনি এখনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক আদর্শে বেশি বিশ্বাসী।

আরো যেসব কারণকে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেন বিশ্লেষকরা তা হলো, ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করা, সারা দেশে কমিটি ও ২০ দলের লিয়াজো গঠনে ব্যর্থ ক্ষমতা হারানোর ১২ বছরেও। অথচ সক্রিয় কমিটি, আদর্শ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কর্মী ছাড়া কোনো দিন কোনো আন্দোলন সফল হয় না। এ কথা ভুলে হাত গুটিয়ে কিছু রুটিন কর্মসূচি, বিবৃতি, মাজার জিয়ারত আর সংবাদ সম্মেলন করে যারা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, তাদের পক্ষে কোনো স্বৈরশাসকের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সত্য উপলব্ধি করে নেতারা মাঠে নামলে ত্যাগী কর্মীর অভাব হবে না। গণজাগরণ আসতে সময় লাগবে না।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...