ফেসবুক আসক্তি ও সামাজিক বাস্তবতা

মাহবুবুল আলম,

  • প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ৩:১৮ অপরাহ্ণ

এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম কোনটি? যে কাউকে এমন প্রশ্ন করলে সবাই নিঃসন্দেহে ফেসবুকের কথা বলবে। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কার্যক্রম শুরু করে মাত্র ১৬ বছরে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠে গেছে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি। ২০০৬ সালের আগস্টের ২২ তারিখ ফেসবুক নোট চালু করা হয়, যা ছিল মূলত একটি ব্লগিং। ২০০৭ সালের ১৪ মে ফেসবুক তাদের বাজার বা মার্কেটপ্লেস চালু করে। এরপর একে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। দিনে দিনে এর ঊর্ধ্বগতি বাড়তে বাড়তে ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন ২৫০ কোটি ছাড়িয়েছে। ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তিকে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৪৫ থেকে বেড়ে ২৫০ কোটিতে পৌঁছায় বলে এক ঘোষণায় এ তথ্য জানিয়েছে ফেসবুক।

অন্যদিকে, ডিজিটাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেপোলিওনকাটের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩৭ লাখ; যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। তবে বর্তমানে তা চার কোটির মতো হবে বলে অনুমান করছে গবেষকরা। যদিও ফেসবুক আমাদের জীবনে একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে। এ যোগাযোগমাধ্যমটি যত জনপ্রিয় হচ্ছে এর প্রতি মানুষের আসক্তিও তত বেড়েই চলেছে; যা নাকি সমাজবিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে।

এক জরিপে দেখা যায়, পৃথিবীতে ২৭০ কোটিরও বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। এরপরই আছে মেসেঞ্জার। তার পরপরই রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব। পৃথিবীর যেসব দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আছে দ্বিতীয় স্থানে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কানাডাভিত্তিক একটি ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠান এ জরিপ পরিচালনা করে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ মে ২০১৯)।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী শিশু-কিশোরদের মধ্যে সামাজিক যোগোযোগমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আমাদের দেশেও বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, আমাদের দেশে মাধ্যমিকে স্কুল চলাকালেই সামাজিক যোগোযোগমাধ্যমে আসক্ত ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী আবার এটি ব্যবহার করছে পাঠদান চলাকালে। ফলে পড়ালেখায় মনোযোগ কমছে। যুক্তরাজ্যের হার্লি স্ট্রিট রিহ্যাব ক্লিনিকের একটি গবেষণায় বলা হয়, শিশুর হাতে স্মার্টফোন/ট্যাব তুলে দেওয়া আর কোকেন বা মদের বোতল তুলে দেওয়া একই কথা। স্মার্টফোন আসক্তি মানুষের মস্তিষ্কের কর্মকাঠামোতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে।

দ্য ইনডিপেনডেন্টে প্রকাশিত বুকার পুরস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ লেখক হাওয়ার্ড জেকসনের বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমের আধিপত্যের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রচুর পরিমাণে ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কারণে নাটকীয়ভাবে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগ পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। এজন্য তারা হারাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাসও।’

সম্প্রতি ফেসবুক আসক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এক গবেষণা পরিচালনা করেন। সেখানে তারা দেখেন, কোকেনে আসক্তি যেরকম ভয়াবহ কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুক আসক্তিও সেরকম। এই গবেষণা প্রতিবেদনটি সাইকোলজিক্যাল রিপোর্টস : ডিজেবিলিটি অ্যান্ড ট্রমা নামক জার্নালে প্রকাশিত হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উদ্ভব ব্যবহারকারীদের বিশেষ করে অল্পবয়সি ব্যবহারকারীদের সমাজ থেকে পৃথক করে দিচ্ছে। এ ছাড়া তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি একা হয়ে যাচ্ছে। আর এই আসক্তি অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চেয়ে ফেসবুকের ক্ষেত্রে বেশি।

ফেসবুক আসক্তি আমাদের সমাজে সৃষ্টি করছে নানা বিড়ম্বনা। এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়া খবর দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে একাধিক ফেইক আইডি খুলে নানা ধরনের ভুয়া খবর বা ভুয়া খবরের লিংক দিয়ে সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। আর কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী যাচাই-বাছাই না করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্য অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন। তাদের ওইসব ফেক নিউজের তথ্যের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে যা মিলে যায় অধিকাংশ মানুষ তা সানন্দে গ্রহণ করেন। এবং এসব দেখামাত্র ফেসবুকে ভাইরাল করে বা বিভিন্নজনের কাছে শেয়ার বা ফরওয়ার্ড করে। ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে মিথ্যা পোস্ট দিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে ফায়দাও লুটছে এক ধরনের মতলববাজ। এ কারণে সমাজে এবিউসিংও বাড়ছে। ছেলেরা মেয়ে সেজে আবার মেয়েরা ছেলে সেজে ফেসবুকে আইডি খুলে নিছক ফান বা মজা করার জন্যও অনেকে পোস্ট দিয়ে থাকেন। কিন্তু এর পরিণতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে, তা একবারও ভেবে দেখেন না। আবার অনেকেই আছেন দিনে কয়েকবার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সাধারণ বিষয়াদি ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট না করে শান্তি পায় না। আরেক ধরনের লোক আছে যারা দুই-চার দিন পর পর প্রোফাইল পিকচার আপডেট করছে। এটাও এক ধরনের আসক্তি বা নেশা। অথচ একবার ভেবেও দেখেন না, তার বারবার আপলোড করা প্রোফাইল পিকচার অন্যের কাছে বিরক্তিকর ও জঞ্জাল মনে হতে পারে। কিছু কিছু ব্যবহারকারী কতক্ষণ পরপরই ফেসবুকে উঁকি দিয়ে দেখেন তার স্ট্যাটাস বা ছবিটাতে কয়টা লাইক বা কমেন্ট এসেছে। লাইক কমেন্ট কম দেখলে উত্তেজিত হন। লাইক কমেন্ট কম পাওয়ার কারণে প্রায়ই ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দেখি; আজ এতজনকে খতম করলাম বা নিষ্ক্রিয়রা আমার লিস্ট থেকে মানে মানে চলে যান নাই আনফ্রেন্ড/ব্লক করে দেব বা চিরনিদ্রায় শায়িতদের বাদ করে শান্তি পাচ্ছি শুধু শুধু আবর্জনা রেখে লাভ নেই এবং ফেসবুকে ঝাড়ু দেওয়া শুরু করেছি, মানিরা মানে মানে কেটে পড়ুন! আরো যে কত কী প্রতিক্রিয়া দেখান, তা বলে শেষ করা যাবে না। এ বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে নানাবিধ মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করছে। মানসিকভাবে তৈরি হয় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতা, একাকিত্ব, অপরাধপ্রবণতা।

বিশিষ্ট কান, নাক ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. প্রাণ গোপাল দত্ত সম্প্রতি চটগ্রামে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলেন, ১৬ বছরের কম বয়সি কারো হাতে মোবাইল ফোন দেওয়া উচিত নয়। বিল গেটস ১৪ বছরের আগ পর্যন্ত নিজের কোনো ছেলেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেননি। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোনে কথা বলা উচিত নয়। অনেকক্ষণ মোবাইল ফোনে কথা বললে মাথাব্যথা, ঘুম না আসা এবং সহজ বিষয়ও ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের উল্লেখ করে তিনি জানান, ফেসবুক মানুষের মস্তিষ্কে কোকেনের মতোই আসক্তি সৃষ্টি করে (মেডিভয়েস, ২৬ এপ্রিল ২০১৯)।

কম সমালোচনা হয়নি ফেসবুক নিয়ে। এর পরও কখনো মুখ খোলেননি স্বয়ং ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। কিন্তু এবার তিনি নিজেই নিজের সমালোচনা করলেন। জাকারবার্গ বলেন, ফেসবুক সমাজকে বিপুল ক্ষতির মুখোমুখি করছে। এ ছাড়াও ফেসবুকের ভাইস প্রেসিডেন্ট চামাথ পালিপিতিয়া জানান, ফেসবুক হলো ভয়ংকর ভুল। তিনি তার সন্তানকে ফেসবুক ব্যবহার করতে দেন না। ফেসবুক থেকে ‘কেনোসা গার্ড’ নামের একটি সশস্ত্র সংগঠনের পেজ সরানোর ব্যর্থতা মূলত পরিচালনাগত ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। ওই পেজ ও ইভেন্ট ফেসবুকের নীতিমালা লঙ্ঘন করেছিল। এ নিয়ে অনেক অভিযোগ আসার পরও তা সরানো হয়নি। এ পেজ বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।

ওই ঘটনায় ফেসবুকের ব্যর্থতার দায় নিয়ে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন জাকারবার্গ এবং ফেসবুকের ভুল স্বীকার করেছেন। শুধু কী যুক্তরাষ্ট্রের কেনোসা শহর! ফেসবুকের কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আমাদের দেশও ফেসবুকে বিরূপ প্রচারণা ও অপপ্রচারের শিকার হয়েছে অনেকবার। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে অস্থিরতার অপচেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতার কারণে এখন খুব সহজেই একজনের সঙ্গে আরেকজনের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এ কারণে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বেড়ে যাচ্ছে।

শেষ করতে চাই এই বলে যে, বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময় ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছে; যার মধ্যে আছে চীন, ইরান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও উত্তর কোরিয়া। শুধু তাই নয়, এটি পৃথিবীর অনেক দেশেই ধর্মীয় বৈষম্য ও ইসলামবিরোধী কর্মের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ফেসবুকের সবকিছুই খারাপ, এ কথা বলা যাবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন জনমত গঠন ও প্রতিবাদ জানানোর একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফরম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক কোনো অন্যায়-অবিচার-অসংগতি দেখলে যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। তাই বলা যায়, এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমের অপব্যবহার রোধ করতে হবে। এ কথা আমরা সবাই জানি, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। ফেসবুকের দায়িত্বশীল এবং পরিমিত ব্যবহারই এর একমাত্র সমাধান হতে পারে।

লেখক : কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক
mahbubulalam15@gmail.com

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...