নিউ ইয়র্কে দেশী কৃষি খামার পরিদর্শন

লিটু আনাম,

  • প্রকাশিত: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার আমেরিকাতে লেবার ডে হিসেবে পালন করা হয় এবং এটি বছরের শেষ লং উইকেন্ড। তাই গ্রীষ্মের শেষ দিকে তিন দিনের বড় ছুটিতে সকলেই কম বেশী ভ্রমন প্ল্যান করে থাকে। আমার তেমন কোন পরিকল্পনা ছিল না কিন্তু হঠাৎ যোসেফ ভাইয়ের ফোন পেয়ে তাদের সাথে যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হলো আমার। এবারের পরিকল্পনা একটু ভিন্ন বলেই মনে হলো আমার কাছে, তাই আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। আমেরিকার মাটিতে দেশীয় কৃষি খামার রয়েছে যোসেফ ভাইদের । সেটাও নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে প্রায় পাঁচ ঘন্টার পথ। এবার লেবার ডে হলিডে পালন হবে যোসেফ ভাইদের পারিবারিক ফার্ম হাউজে।

যোসেফ ভাই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই। তাদের একটি ফার্ম হাউজ রয়েছে নিউ ইয়র্কের আপস্টেট হ্যামিলটনে। এবং অন্যটি ফ্লোরিডায়। দুটোই সম্পুর্ন বাংলাদেশী কৃষি খামার। নাম মনির ফার্ম হাউজ। করোনার কারনে ফ্লোরিডা যাওয়া সম্ভব নয় তাই হ্যামিলটন যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। সপ্তাহ খানেক আগে যোসেফ ভাই ফোন করে বললেন যে আমাদের এই প্ল্যান, আমি যাবো কিনা? ঘোরার ব্যপারে আমার কোন না নেই তাও যদি সাথে প্রিয় মানুষ গুলো হয় তাহলে তো কথাই নেই। যোসেফ ভাই-উর্মি ভাবী, রাশা ভাই-শ্যামলী আপু, মিল্টন ভাই-ভাবী আমার খুবই শ্রোদ্ধাভাজন। তারাও আমাকে খুবই আদর করেন। তাদের সঙ্গে তিন দিনের একটি ট্যুর আমার জন্য যেন সৌভাগ্যের। যোসেফ ভাই নিজে সব আয়োজন করলেন। আমারিকায় বাংলাদেশী কৃষি খামারের কথা অনেক শুনেছি কিন্তু দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এসব ফার্মের অভ্যন্তরীন কিংবা ব্যবসায়িক আলোচনা নয় বরং আমাদের আনন্দময় ভ্রমন অভিজ্ঞতাই বর্ননা করতে চাই।

গত ৫ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল ১০ টার মধ্যে আমি ব্রুকলিনের যোসেফ ভাইয়ের বাসায় হাজির হই। যোসেফ ভাই আর ভাবী রেডিই ছিল। আমি যাওয়া মাত্রই সব মালপত্র গাড়িতে তুলে আমরা রওনা দিলাম।আমাদের নিউ জার্সি থেকে রাশা ভাই আর শ্যামলী আপুকে পিকাপ করতে হবে। নিউ জার্সিতে রাশা ভাই-শ্যামলী আপুর বাসায় আধা ঘন্টার চা নাস্তা ব্রেক দিয়ে আমাদের মূল যাত্রা শুরু হলো।
জার্সি সিটি থেকে হ্যামিলটনের দুরত্ব প্রায় ২৫০ মাইল। আমরা জিপিএস ফলো করে চলতে লাগলাম। নিউ জার্সি পার হওয়ার পর থেকে প্রকৃতি যেন বদলে গেল। দুই পাশে ছোট বড় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। গ্রীষ্ম যেন শেষবারের মত তার সৌন্দর্য্যের ডালা সাজিয়ে বসেছে। কোন এক বিখ্যাত শিল্পী যেন তার প্রতি আচর অত্যন্ত যত্ন সরকারে মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকেছেন। আমাদের পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।কিন্তু এখনও চারপাশে গৌধুলীর আলো। যোসেফ ভাই একটি ফার্মের ভিতরে গাড়ি পার্ক করলো।পাশে একটি বিশাল বাংলো বাড়ির মতো বাড়ি। তার সামনেই বড় বড় খামার ঘর, পাশেই লেবারদের রুম। তার ঠিক পিছনেই প্রসেসিং ফার্ম এরং চারপাশ জুড়ে বিশাল কৃষি খামার। অন্ধকার হয়ে আসছে তাই আজকে আর ফার্ম ঘুরে দেখা হলো না। আমরা মিল্টন ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আধা ঘন্টার মধ্যে মিল্টন ভাইও চলে আসলেন। এরই মধ্যে আমি আর যোসেফ ভাই বাংলোর সামনে দোলনা আর সোফা দিয়ে সাত জনের বসার ব্যবস্থা করলাম। কারন রাতে খাওয়ার পর আড্ডা না হলে কোন ট্যুর ঠিক জমে না।

রাতের খাবার আমরা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা ফ্রেশ হতে হতে রাতের খাবারের আয়োজন হলো। খাওয়া শেষে আমরা একে একে বাইরে গিয়ে বসলাম। সকলের খুব আফসোস হচ্ছিল আজ পুর্নিমা না বলে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুরে খামার প্রজেক্টের উপর একটি মাত্র বাতি জ্বলছে। তাই জোছনার অভাব বেশী রকম অনুভব হচ্ছিল। গল্পে আড্ডায় কখন যে রাত ১২টা বেজে গেল আমরা কেউ টেরই পাইনি। রানু ভাবীর কাল সকাল উঠতে হবে তাড়া শুনে আমাদের হুঁশ হলো। সেদিনের মত আমরা আড্ডা শেষ করে ঘুমাতে গেলাম।

পরদিন রবিবার সকাল ৯ টার দিকে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমার রুমের পাশেই কিচেন তাই কিচেনের টুংটাং শব্দে আগেই উঠতে হলো। তাছাড়া আজই ট্যুরের বিশেষ দিন। সব প্ল্যান আজকে ঘিরেই। তাই উঠে ফ্রেশ হয়ে ঝটপট নাস্তা করে নিলাম। তারপর যোসেফ ভাই আমাদের ফার্ম দেখাতে নিয়ে গেলেন। প্রায় ১০০ একরের বিশাল ফার্ম ঘুরে দেখতে এক সপ্তাহ লাগবে তাই আমরা কাছাকাছি যতদুর পারি ঘুরে দেখলাম। খোলা আকাশের নিচে দেশী উপায়ে সবজি চাষের পাশাপাশি ৫২টি বিশাল আকৃতির গ্রীন হাউজ প্লাট রয়েছে। একটি প্লান্টে শুধু এক রকমের সবজি চাষ করা হয়েছে। মিষ্টি কুমড়া, লাউ, লাল শাক, ডাটা শাক, পাট শাক, বেগুন, ঢেঁড়স, মরিচ, টমেটো, শশা সহ প্রায় সকল ধরনের সবজি রয়েছে। তবে করোনার কারনে এবার সীমিত আকারে সবজি চাষ করা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক থেকে ৫ ঘন্টার দুরত্বে দেশী সবজির এতো বড় খামার হতে পারে সেটা আমাদের কল্পনাতেই ছিল না। যোসেফ ভাই জানালেন যে এখানে সম্পূর্ন অর্গানিক উপায়ে কোন প্রকার সার কিংবা কিটনাশক ছাড়াই সব ধরনের সবজি চাষ করা হয়। আমরা লালশাক, ডাটাশাক, লাউ শাক, পাট শাক ও টমেটো তুলে আনলাম দুপুরে খাওয়ার জন্য। আজকের দুপুর ও রাতের মেন্যু হচ্ছে ফ্রেশ সবজি। আমরা সবাই ফ্রেশ সবজি পেয়ে মহা খুশি। আসলে প্রবাস জীবনে সরাসরি ক্ষেত কিংবা খামার থেকে সবজি তুলে রান্না করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। যাদের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে তারা ছোট আকারে সবজি বাগান করলেও এতো বড় খামার থেকে সবজি সংগ্রহ করা সত্যি অন্যরকম অনুভুতির। আমরা ভাবীদের কাজে একটু সাহায্য করলাম।রান্না চুলোয় উঠানোর পর আমরা কফি খেতে গেলাম পাশের ছোট্ট হ্যামিলটন শহরে। ছোট ছবির মতো শহরে একটু ঘুরে আসতে আসতে দেখি দুপুরের খাবার রেডি। আমরা সকলেই ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খেতে বসলাম। চমৎকার সব আয়োজন। লালশাক, পাট শাক, লাউ শাক, একটি তেল ছাড়া ডাটা শাক রান্না করেছিলেন সম্ভবত রানু ভাবী (মিল্টন ভাইয়ের স্ত্রী)। বলতে পারে আমরা সবাই কবজি ডুবিয়ে খেলাম। তিনদিনের জন্য আমি আমার ডায়েট ভুলে গেলাম। আমি আগে পাট শাক খেতাম না কিন্তু সকলের খাওয়া দেখে না খেয়ে পারলাম না। লালশাক এবং লাউ শাক তো নিয়মিতই খাই কিন্তু তেল বিহীন ডাটা শাক এবং পাট শাক প্রথম খেলাম। স্বাদ যেন আজও মুখে লেগে আছে। এখানে রাধুনীদের কৃতীত্ব না দিলে বিধিবাম নারাজ হবেন।

খেতে খেতে প্রায় বিকাল চারটা বেজে গেল। তাই আর দেরী না করে বেরিয়ে পরলাম।পুরোটাই দেখার বাকি। খুব ছোট্ট একটি শহর হ্যামিলটন। মোট জনসংখ্যা পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। করোনার কারনে কোথাও কেউ নেই মনে হলো। অনেক সময় পর পর একটু গাড়ি কিংবা কোন মানুষের দেখা পাওয়া যায়। চার পাশে পাহাড়ে ঘেরা ছবির মতো শহর। ফার্মের ঠিক পিছনেই একটি বিশাল লেক। আর ফার্মের অপরদিকে পাহাড়। পাহাড় আর লেক যেন খামারের সীমারেখা। সবকিছু মিলিয়ে এ এক নৈস্বর্গিক কান্ড। আমরা লেক পার এবং এলাকা ঘুরে দেখলাম। লেকে মাছ ধরার পরিকল্পনা থাকলেও সময়ের অভাবে সেটা বাদ দেওয়া হলো। আমরা চললাম চিত্বেনাঙ্গো ফল্সের দিকে।শহর থেকে ২০ মিনিট দুরত্বে সুন্দরের আরো এক প্রতিমা হচ্ছে এই চিত্বেনাঙ্গো ঝর্না।চোখে না দেখলে আমরা মতো ক্ষুদ্র লেখকের পক্ষে এর সৌন্দর্য্য বর্ননা করা সম্ভব নয়। মিল্টন ভাই এবং ভাবী শারীরিক অসুস্থতার জন্য ফলসের নিচে নামতে পারলেন না। আমরা পাঁচজনই গেলাম নিচে যেখানে প্রায় ২০০ ফুট উপর থেকে পানি আছড়ে পরছে। সকলেই আমরা পানিতে নেমে পরলাম। ছোট বড় পাথরের উপর দিয়ে ঝর্নার পানি বয়ে চলেছে। আমার ভাই ভাবী সেই পানিতে জলকেলি খেলতে লাগলো। আমি ব্যস্ত ছিলাম ছবি তোলার কাজে।অনেক ফটোসেশন হলো আমাদের। নায়েগ্রা ফলসের পর আমার দেখা সেরা ফল্স এটি। মিল্টন ভাই আর ভাবীর জন্য আফসোস হচ্ছিল এই ভেবে যে এতো বড় একটি সৌন্দর্য্য তারা উপভোগ করতে পারলেন না।

Chittenango Falls থেকে আমরা গেলাম Owena Voneyards. এখানে হালকা খাবার এবং নিজস্ব বাগানের আঙ্গুর থেকে তৈরী ওয়ান টেস্ট করার উদ্দেশ্যেই এখানে যাওয়া। কিন্তু করোনার কারনে বন্ধ থাকায় আমরা নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম। ফার্ম হাউজে ফেরার পথে আমরা গেলাম Colgate University দেখতে।ছোট ক্যাম্পাস হলেও নিখুঁত ভাবে সাজানো ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোন। পুরা ক্যাম্পাস আমরা গাড়ি নিয়েই ঘুরলাম। লকডাউনের প্রভাব চোখে পরলো আমাদের। এতো সুন্দর ক্যাম্পাস তাতে নেই কোন আড্ডা, নেই কোন দলবেধে ছাত্রদের পদচারনা। চারিদিকে নিরবতাই যেন ক্যাম্পাসের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে। ফার্ম হাউজে ফিরতে ফিরতে আমাদের রাত হয়ে গেল। রাতের খাবার খেয়ে আবার চলল আড্ডা মধ্যরাত অবধি।

পরদিন সকালে নাস্তা করে আমরা আবার গেলাম ক্ষেতে। এবার সবজি সংগ্রহ করবো নিয়ে আসার জন্য। আমরা ঘুম থেকে উঠার আগেই যোসেফ ভাই টমেটো, শশা, কুমড়া তুলে রেখেছেন। তখন আমরা শুধু সবজি সংগ্রহ করলাম যে যত নিতে চায় সেই হিসেবে। ক্ষেতের সব রকমের সবজি তুলে দুই গাড়ির ট্রাঙ্ক বোঝাই করে আমরা রওনা দিলাম নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে। যোসেফ ভাই আবার দুই পাশে পাহাড়ের মাঝ বরাবর সবুজের মাঝে সিতি কাটা হইওয়ে ধরে গাড়ি ছুটিতে চললেন তিনদিনের ছুটি শেষে ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে। সাথে নিয়ে ফিরলাম নতুন এক অভিজ্ঞতা, জীবনের আনন্দঘন কিছু মুহুর্তের স্বাদ।

 

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...