গ্রিন ফ্যাক্টরির শীর্ষে বাংলাদেশ

রেজাউল করিম খোকন,

  • প্রকাশিত: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ৫:৪১ অপরাহ্ণ

দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে পোশাকশিল্প খাত থেকে। তবে করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে এ খাত নিয়ে চরম শঙ্কা তৈরি হয়। বাতিল হয়ে যায় অনেক অর্ডার। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে স্বরূপে ফিরতে খুব বেশি দেরি হয়নি। অল্প সময়ের ব্যবধানে বাতিল হওয়া অর্ডারগুলো পুনরায় ফিরে আসতে থাকে। ফলে করোনার মাঝেও চমক দেখিয়েছে পোশাক খাত। একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা বা গ্রিন ফ্যাক্টরির সংখ্যাও। আগে থেকেই সবুজ কারখানার তালিকায় বিশ্বে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরো তিনটি কারখানা। এ নিয়ে দেশে সবুজ কারখানার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৭১টি। তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, এ তালিকায় নাম লেখাতে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো ৫৫০টি কারখানা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডিজাইন (এলইইডি) সংগঠনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারখানাকে এ সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। ক্রেতারা কোনো কারখানা থেকে পোশাকপণ্য কেনার সময় এলইইডির গ্রিন ফ্যাক্টরির সার্টিফিকেট আছে কি-না, তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে থাকে। এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডিজাইনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সুবজ কারখানা বা গ্রিন ফ্যাক্টরির সংখ্যা এখন ১৭১টি। এর মধ্যে প্ল্যাটিনাম ক্যাটাগরিতে রয়েছে ৫৩টি। এছাড়া গোল্ড ক্যাটাগরিতে ১০৪টি, সিলভারে ১০টি। আর সার্টিফাইড চারটি। তা ছাড়া এখনো গ্রিন ফ্যাক্টরি হতে রেজিস্ট্রেশন বা পাইপলাইনে রয়েছে আরো ৫৫০টি কারখানা। গ্রিন ফ্যাক্টরিতে আমাদের দেশ এখনো শীর্ষে।

পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়াতে এলইইডির সার্টিফিকেট গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমেই জানতে চায়, তাদের পোশাকপণ্য কোথা থেকে এসেছে? কোন পরিবেশে তৈরি হয়েছে? সেখানে কীভাবে উৎপাদন হয়েছে বা কোনো ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল আছে কি-না এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে এলইইডি সার্টিফিকেটের বিকল্প নেই। শিল্পায়ননির্ভর অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিগত চার দশকে একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে আমাদের যে যাত্রা তার মূলে রয়েছে শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ, বিশেষ করে শ্রমনির্ভর ম্যানুফ্যাকচারিং খাত।

৭০ দশকের শেষের দিকে যাত্রা শুরু করে এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে আমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছি। প্রায় ৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান এবং পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস এই শিল্পের জিডিপিতে অবদান ১১ শতাংশ। দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে অব্যাহত অবদান রাখার পাশাপাশি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, শ্রমিকের ক্ষমতায়ন এবং সবুজ শিল্পায়নেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এই শিল্প। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠান কিউআইএমএ বাংলাদেশের পোশাক খাতকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এথিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পরিবেশবান্ধব সবুজ শিল্পায়নেও আমাদের গার্মেন্ট খাত অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।

ক্রম পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে শিল্পের ভূমিকার বিষয়টিকেও নজর রাখতে হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় পরিবেশ ও জলবায়ুর বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণাটি আমাদের দেশে নতুন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণা আমাদের গার্মেন্টশিল্পে ব্যাপকভাবে চালু হওয়ায় গোটা অর্থনীতিতে এর চমৎকার অনুকূল প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমাদের গার্মেন্ট খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়নে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার দ্রুত বিকাশ সবাইকে আস্থাশীল করে তুলেছে।

সাভারে রানা প্লাজা ধস কিংবা তাজরিন গার্মেন্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্প বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল, এর ফলে ভাটা পড়েছিল এ খাতে। বিদেশি ক্রেতারাও আস্থার সংকটে পড়েছিল। বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্প। পরিবেশবান্ধব টেকসই কারখানা বা ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠায় রীতিমতো তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে। এর মাধ্যমে সারা দেশে একে একে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণাটি আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দিনে দিনে আরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি। আগামীতে আরো অনেকগুলো গার্মেন্ট কারখানাকে সবুজায়নের আওতায় আনার প্রক্রিয়া জোরেশোরে চলছে। শ্রমিকবান্ধব গার্মেন্ট কারখানা প্রতিষ্ঠায় মালিকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সুফল বয়ে এনেছে, অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে বলা চলে।

গার্মেন্টশিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরির ধারণা নিঃসন্দেহে নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছে উদ্যোক্তাদের মধ্যে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণা দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সন্দেহ নেই। এতে বিদেশি ক্রেতারা অবশ্যই আকৃষ্ট হবেন জোর দিয়ে বলা যায়। রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে যাবে বহুগুণ। বর্তমানে যারা নতুন কারখানা চালু করছেন, তারা গত কয়েক বছরে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকেই কারখানা স্থাপন করছেন, তা বলাই বাহুল্য। কারণ তারা উপলব্ধি করেছেন এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কারখানা না হলে বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার দেবেন না। তাই উদ্যোক্তারা ব্যবসার আইনকানুনের পাশাপাশি দেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইন মেনে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আবার সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্ট না হলে নতুন কোনো কারখানাকে বিজিএমইএ থেকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। একটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে পানি, বিদ্যুৎ, রং এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব উপায়ে হচ্ছে কি-না তা দেখা হয়। অধিকাংশ পোশাকশিল্প কারখানা ইটিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ইটিপির পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করছে, যা আমাদের সবুজ বিপ্লবেরই একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত।

বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে অর্থায়নের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও করপোরেট গভর্ন্যান্স (ইএসজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আরো গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের টেকসই ও স্বল্প কার্বনফুট প্রিন্ট সম্পন্ন পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে কনজুমারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো পরিবেশের সুরক্ষা। পরিবেশবান্ধব, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হলেও গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে আমাদের গার্মেন্ট খাতকে। অনেক বাধা, বিপত্তি প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আমাদের গার্মেন্ট খাতকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশ সুরক্ষার দিকে সবাইকে আলাদা মনোযোগ দিতে হচ্ছে।

গার্মেন্টসামগ্রী ক্রেতা দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, গোষ্ঠী এখন গার্মেন্ট উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব নানা শর্ত আরোপ করছেন। যেসব শর্ত পূরণের মাধ্যমেই কেবল তাদের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। আর এজন্য এখন গার্মেন্টশিল্পে কমপ্লায়েন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। অতীতে এ বিষয়টিকে এক প্রকার অগ্রাহ্য করা হয়েছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পেছনেও বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আর্থিক ক্ষেত্রে গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার বিকাশ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে যা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকসই অর্থনীতির জন্য গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার অনুসারী হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। যার চমৎকার ফলাফল ক্রমেই অর্থনীতিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইভাবে গার্মেন্টশিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার পরিপূর্ণ বিকাশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে আরো এগিয়ে নেবেÑ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। গ্রিন ফ্যাক্টরি কার্যক্রমকে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ ক্ষেত্রে চমৎকার গতির সঞ্চার হবে আশা করা যায়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...