আমাদের ২ বোনের তোমরাই আপনজন, এতিমদের প্রধানমন্ত্রী

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ১৪ আগস্ট ২০২০, ৭:১৬ অপরাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আজকে একটা হত্যাকাণ্ড হলে সবাই বিচার চাইতে পারে, মামলা করতে পারে, ১৫ আগস্ট আমরা যারা আপনজন হারিয়েছিলাম আমাদের কারও মামলা করার বা বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না। সেই অধিকারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করে। খুনীদের সমস্ত দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।

শুক্রবার সকালে ৫০ হাজার বার পবিত্র কোরআন খতম এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত দোয়া মাহফিলে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসম প্রধানমন্ত্রী এতিমদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা একেবারে একা না। আমরা আছি তোমাদের পাশে। আমি এবং আমার ছোট বোন সব সময় তোমাদের কথা চিন্তা করি। আমি যতক্ষণ আছি তোমাদের পাশে থাকবো। তোমরাই আমাদের আপনজন। আমাদের দুই বোনের তোমরাই আপনজন।

এতিমদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তোমরা যারা এখানে উপস্থিত এবং অন্যান্য যারা আছ- সবাইকে বলবো-তোমরা ছোট বেলা পিতামাতাকে পাওনি। অনেকে পিতাকে পাওনি, অনেকে মাকে পাওনি। অনেকে কাউকেই পাওনি। অতএব স্নেহ ভালবাসা কি জিনিস সেটা তোমরা উপলব্ধি করতে পারনি। আমার মা মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন। এরপর ৫ বছর বয়সে তার পিতাকে হারান। ৭ বছর বয়সে দাদাও মারা যান। সম্পূর্ণ এতিম অসহায় হয়ে পড়েন।

এই কষ্টটা আমি বুঝি এই কারণে। কারণ আমি আমার মায়ের বড় সন্তান। মায়ের যে কষ্ট মা আমার সঙ্গে সব সময় বলতেন। সে জন্য এই কষ্টটা আমি বুঝি।

এই কষ্ট আরও বুঝলাম ৭৫ এর ১৫ আগস্ট। একদিন সকালে উঠে যখন শুনলাম আমাদের কেউ নেই। এই ১৫ আগস্ট আমি হারিয়েছি আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সব সময় ছায়ার মতো আবার বাবার সঙ্গে ছিলেন।

আমার ছোট ভাই, আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট ছিল, ক্যাপ্টেন শেখ কামাল সে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাকে হত্যা করে, তার নবপরিণিতা বধু সুলতানা কামালকেও হত্যা করে। যার হাতের মেহেদীর রঙ তখনো মোছেনি। বুকের রক্তে তার হাত যেন আরও রাঙিয়ে যায়। তার থেকে ছোট লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, সে সেনা বাহিনীর একজন অফিসার। বিলাতে মিলিটারি একাডেমী থেকে ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে যোগদান করেছিল।

তাকেও এই খুনীরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরই কিছু বিপথগামী সদস্য এবং কিছু উচ্চপদস্থ ছিল যারা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল। হত্যা করেছিল তারও নবপরিণিতা বধু রোজী জামালকে। যে আমার ছোট ফুফুর মেয়ে ছিল। অনেক শখ করে তাকে ঘরে আনা হয়েছিল। আমার একমাত্র চাচা শেখ আবু নাসের। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি পঙ্গু ছিলেন। কিন্তু তিনিও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাকেও নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

ছোট ভাইটি- আমি এখনো এই প্রশ্নের উত্তর পাই না। তার মাত্র ১০ বছর বয়স। তার জীবনের স্বপ্ন ছিল সে একদিন সেনাবাহিনীতেই যোগদান করবে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস তাকে সেই সেনাবাহিনীর সদস্যরাই নির্মম ভাবে গুলি করে হত্যা করলো। তার অপরাধ কি?

কর্ণেল জামিল যিনি আমার বাবার মিলিটারি সেক্রেটারি ছিলেন। এই খবর পেয়ে তিনি ছুটে এসেছিলেন। তাকেও তারা হত্যা করেছিল। তিনি তো সামরিক বাহিনীর বড় অফিসার ছিলেন। কিন্তু এই সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল।

আমি আর আমার ছোট বোন বিদেশে ছিলাম। আমি স্বামী তখন জার্মানিতে। আমি সেখানে গিয়েছিলাম। অল্প কিছু দিনের জন্য। কিন্তু আর দেশে ফিরতে পারিনি। ৬ বছর আমাদের দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। আমার বাবার লাশও দেখতে পারিনি। কবরও জিয়ারত করতে পারিনি। আসতেও পারিনি। এভাবে আমাদের বাইরে পড়ে থাকতে হয়েছিল। এক এতিম হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে বিদেশের মাটিতে রিফিউজি হয়ে থাকার মতো কি কষ্ট এটা আমাদের মতো যারা ছিল তারা জানে। আমাদের পরিবারের আত্মীয় স্বজন যারা গুলিতে আহত, যারা কোন বেঁচে ছিল তারাও ওভাবে রিফিউজি হয়ে ছিল দিনের পর দিন।

আজকে একটা হত্যাকাণ্ড হলে সবাই বিচার চাইতে পারে, মামলা করতে পারে ১৫ আগস্ট আমরা যারা আপনজন হারিয়েছিলাম আমাদের কারও মামলা করার বা বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না। সেই অধিকারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করে। খুনীদের সমস্ত দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তারা পুরস্কৃত হয়েছিল এই খুন করার জন্য। নারী হত্যাকারী, শিশু হত্যাকারী, রাষ্ট্রপতি হত্যাকারী তাদের পুরস্কৃত করা হয়।

এই রকম ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে। আমি সেই অবস্থা থেকে পরিবর্তন আনতে চাই। এদেশে সব মানুষ যেন নিরাপদে থাকতে পারে, সব মানুষ সুন্দর ভাবে বাঁচতে পারে, ন্যায়পরায়ণতা যেন সৃষ্টি হয়। মানুষের অধিকার যেন সমুন্নত থাকে সেদিকে আমরা লক্ষ্য রাখি। আর স্বাভাবিক ভাবে নিজেরা এতিম হয়েছি বলে এতিমের কষ্টটা আমরা খুব ভাল বুঝি। তাইতো আমাদের সব সময় চেষ্টা।

আমাদের সব সময় প্রচেষ্টা থাকবে যারা এতিম, মা-বাপ হারা তারা যেন সুষ্ঠুভাবে মানুষ হতে পারে। তোমরা মন দিয়ে পড়াশোনা করো। নিজের পায়ে দাঁড়াও। তোমরা একেবারে একা না। আমরা আছি তোমাদের পাশে। আমি এবং আমার ছোট বোন সব সময় তোমাদের কথা চিন্তা করি। জন্মদিন কোন পার্টি করি না। আমরা চেষ্টা করি তোমাদের মতো শিশুদের নিয়ে উৎসব করতে।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তোমাদের পাশে আছি। আমি যতক্ষণ আছি তোমাদের পাশে থাকবো। তোমরাই আমাদের আপনজন। আমাদের দুই বোনের তোমরাই আপনজন।

তোমাদের মধ্যে অনেক মেধাবী আছো, যারা একদিন এই দেশে অনেক বড় কাজ দেশের জন্য করতে পারবে। মানুষের জন্য করতে পারবে। সেভাবে কাজ করবে। সততা নিষ্ঠা একাগ্রতা নিয়ে কাজ করবে।

তিনি বলেন, মানুষ একটা শোক সইতে পারে না। আর আমরা কি সহ্য করে আছি। শুধু একটা চিন্তা করে যে এই দেশটা আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। তিনি দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চান। আমার যতটুকু সাধ্য সেইটুকু করে দিয়ে যাবো যেন তার আত্মাটা শান্তি পায়। এবং এই রক্ত যেন বৃথা না যায়।

সমাজসেবা অধিদপ্তর এ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছিল। সমাজসেবা অধিদপ্তর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ দোয়া মাহফিলে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রান্তে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...