স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী

২৩ সেপ্টেম্বর (বুধবার) নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রথম অগ্রদূত কুমিল্লার লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর ১১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। নারী শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মুসলিম নারী হিসেবে বৃটেনের মহারাণী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক ‘নওয়াব’ উপাদি পেলেও স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও ইতিহাসের আলোচিত এ মহিয়সী নারী রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন।

উপমহাদেশের একমাত্র নারী নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী নারী জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। বেগম রোকেয়ার জন্মের ৪৬ বছর আগে কুমিল্লার লাকসামের পশ্চিমগাঁও এলাকায় ১৮৩৪ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেছা জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান সময়ে মহিয়সী নারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বীকৃত বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর আগে অন্ধকার যুগে নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রনায়ক নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী নারীদের জন্য উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দুঃসাহস দেখিয়েছেন।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা ছিলেন জমিদার আহমদ আলী চৌধুরী ও আরফান্নেছা চৌধুরাণীর প্রথম কণ্যা। রক্ষণশীল সমাজে জমিদার বাড়ির কড়া পর্দাপ্রথার মধ্যে বেড়ে ওঠা ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি বাংলা, আরবী, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় বেশ পারদর্শী ছিলেন।
আনুমানিক ১৮৬০-১৮৬১ সালে কুমিল্লার ভাউকসারের জমিদার মোহাম্মদ গাজীর চৌধুরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও দু’ কন্যা সন্তান জন্মের পর ১৮৬৬ সালে তাদের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়। এরপর ফয়জুন্নেছা পশ্চিমগাঁও পিত্রালয়েই থেকে যান। জীবনের শেষ ত্রিশ বছর তিনি এখানে থেকেই নারী শিক্ষার প্রসারে অনন্য ভূমিকা রাখেন।

বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে তিনিই একমাত্র নারী যিনি সর্বপ্রথম চিন্তা করেছিলেন আধুনিক শিক্ষা না পেলে নারীরা সমাজে পিছিয়ে পড়বে। তাই দুঃসাহসিক উদ্যোগ নিয়ে মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর আগে ১৮৭৩ সালে কুমিল্লা শহরের বাদুড়তলায় প্রতিষ্ঠা করেন ফয়জুন্নেছা উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয়। যা বর্তমানে ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত। ১৯০১ সালে লাকসামে ‘ফয়জুন্নেছা ডিগ্রি কলেজ’ ও ‘বিএন হাইস্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। নারী স্বাস্থ্য সেবায় তিনি ১৮৯৩ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেছা মহিলা ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নওয়াব ফয়জুন্নেছা ১৮৯৯ সালের দেশের ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের নির্মাণ কাজে তৎকালীন সময়ে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেন। শিশুদের শিক্ষা বিস্তারে তিনি নওয়াব ফয়জুন্নেছা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে ‘পশ্চিমগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ হিসেবে চালু রয়েছে।
এছাড়া দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, পুল, ব্রীজ, কালভার্ট ও মসজিদ নির্মাণ করে একজন দক্ষ নারী নেত্রীর ভূমিকা রাখেন। বাংলার নারী ইতিহাসে নওয়াব ফয়জুন্নেছার দৃষ্টান্ত অতি বিরল। শুধু শিক্ষা বিস্তারেই নয়। নওয়াব ফয়জুন্নেছা ছিলেন একজন সাহিত্যনুরাগী। তিনি ছিলেন বৃটিশ ভারতের প্রথম কবি। তাঁর রচিত রূপজালাল কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। এ কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও ফয়জুন্নেছার সঙ্গীতসার ও সঙ্গীত লহরী নামে দু’টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুধাকর ও মুসলমান বন্ধু পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। অসাধারণ উদ্যমী ফয়জুন্নেছাকে বৃটেনের রাণী ভিক্টোরিয়া ‘বেগম’ উপাধি দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ‘বেগম’ স্ত্রীলিঙ্গ বলেই তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরে রাণী ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ সালে ফয়জুন্নেছাকে ‘নওয়াব’ উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষে খেতাব পাওয়া প্রথম মুসলিম মহিলা জমিদার।

১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর জীবনাবসান ঘটে। তাকে তার প্রতিষ্ঠিত দশগুম্বুজ মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। নারী শিক্ষার প্রসার ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকার পরও নওয়াব ফয়জুন্নেছাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দেয়া হয়নি। বিগত ২০০৪ সালে একরকম অবহেলা ও অসম্মান করেই ফয়জুন্নেছাকে যৌথভাবে একুশে পদক দেয়া হয়। ২০০৮ সালে জাতীয় জাদুঘরে বেগম রোকেয়া ও বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের পাশে করা স্থাপন করা হয় ফয়জুন্নেছা কর্নার। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন নির্বাচিত সরকারের আমলেও নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী তাঁর কর্মের স্বীকৃতি পাননি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও অবহেলিত থেকে যাচ্ছেন ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আজাদ সরকার লিটন জানান- নারী জাগরণের উজ্জ্বল নক্ষত্র নওয়াব ফয়জুন্নেছার জন্ম ও মৃত্যু দিবস জাতীয়ভাবে পালন করা উচিত। মহিয়সী এ নারীর স্মৃতি রক্ষায় চালু করা যেতে পারে ‘ফয়জুন্নেছা পদক’।

লাকসাম পৌরসভার মেয়র অধ্যাপক আবুল খায়ের জানান- কুমিল্লার খ্যাতিমান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম একজন নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী। তৎকালীন সময়ে পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু ওই সময়ে সুষ্ঠু প্রচারণার অভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি যথাযথ স্বীকৃতি পাননি। বর্তমান উন্নয়নবান্ধব সরকারের আন্তরিকতায় তিনি কর্মের স্বীকৃতি পেয়েছেন।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বিষয়ে জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোঃ আতাউর রহমান বলেন- নওয়াব ফয়জুন্নেছা নারী জাগরণের অগ্রদূত। তাঁর স্মৃতি রক্ষায় বর্তমান সরকার আন্তরিক। ইতোমধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে তাঁর বাড়িকে আকর্ষনীয় প্রত্নপর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বাড়িতে একটি উন্মুক্ত যাদুঘর চালু করা হবে। এ জন্য ৩০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সমাজে নারীদের পিছিয়ে পড়া সময়ে ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী নারী শিক্ষা ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে নজির রেখেছেন তাঁর স্বীকৃতি পাবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।

[১] [২] [৩]