তাঁর নেতৃত্ব বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ

এম. নজরুল ইসলাম,

  • প্রকাশিত: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মানুষের ধর্ম প্রবন্ধের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘মানুষের একটা দিক আছে যেখানে বিষয়বুদ্ধি নিয়ে সে আপন সিদ্ধি খোঁজে। সেইখানে আপন ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত। সেখানে যে জীবরূপে বাঁচতে চায়। …
স্বার্থ আমাদের যেসব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি জীবপ্রকৃতিতে; যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’

বাংলাদেশের চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ‘মানুষের ধর্ম’ তাঁর ব্রত। জনসেবাই তাঁর তপস্যা। তাঁর বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সর্বজনীন ও সর্বকালীন মানব’ হিসেবে বাঙালি জাতির হƒদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গকারী এই মহামানবের কন্যা শেখ হাসিনাও নিজেকে উৎসর্গ করেছেন মানুষের কল্যাণে। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম, পারিবারিকভাবেই তাই ‘কল্যাণমন্ত্রে দীক্ষা’ হয়েছে শৈশবে। রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করেই তাঁর সম্পর্কে বলা যেতে পারে, তিনি ‘সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ’।

সত্যিকার অর্থেই দেশের মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির মূর্ত প্রতীক তিনি। বদ্ধ জানালার কপাট খুলে দিতে প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন ১৯৮১ সালে। সেদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের অনেক তফাৎ। সেদিনের বাংলাদেশ ছিল কার্ফিউ গণতন্ত্রীদের শাসনে। তখন জান্তার বুটের তলায় পিষ্ট মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই দম বন্ধ করা পরিবেশ দূর করতেই দেশে ফিরেছিলেন তিনি। তাঁর আগমনে সেদিন উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল সারা দেশ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে তিনি দলকে সংগঠিত করেন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বেই ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় দল। প্রথমবারের মত নির্বাচিত হয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসেন তিনি।

১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি। এই সময়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের সবচেয়ে বড় দুটি সাফল্য বা অর্জন হলোÑপার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি এবং ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ও স্বীকৃতির চিহ্ন হিসাবে শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালে ২২ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার পান। কৃষিতে অসামান্য অবদানের জন্য শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সেরেস পুরস্কারে ভূষিত হন।

আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের আজকের অবস্থান প্রমাণ করে শেখ হাসিনা অনেক বড় মাপের রাষ্ট্রনায়ক। বাংলাদেশের স্বার্থে তিনি যে তাঁর বাবার মতোই আপোসহীন, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থনে বিশ্ব ব্যাংকের মতো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করার সতো শক্তি ও সাহস অর্জন করেছেন তিনি। তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নানা সমস্যা সমাধানেও তিনি একজন বিশ্বনেতা হিসেবে নিজের অভিমত তুলে ধরেছেন সবসময়। জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে সংস্থাটির সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ‘ডিজিটাল কো-অপারেশন : অ্যাকশন টুডে ফর ফিউচার জেনারেশন’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে উদীয়মান চাকরির বাজারের কথা বিবেচনা করে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে ডিজিটাল একাডেমি অ্যান্ড সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যের কথা তুলে ধরে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের তরুণদের দিন বদলের এই যাত্রার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে চাই।’

জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য পাঁচ দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।’ তৃতীয় প্রস্তাবে বলেছেন, দুর্বল দেশগুলোকে প্রতিশ্র“ত তহবিল সরবরাহ করতে হবে। তাঁর দেওয়া চতুর্থ প্রস্তাবটি হচ্ছে, দূষণকারী দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রশমন ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের এনডিসি বা জাতীয় নির্ধারিত অবদান বাড়াতে হবে।

পঞ্চম প্রস্তাবে তিনি বলেছেন, জলবায়ু শরণার্থীদের পুনর্বাসন একটি বৈশ্বিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে ‘উলে¬খযোগ্য সাফল্য’ পেলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈরী আবহাওয়া কৃষি, শিল্প ও সামাজিক কাঠামোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ যে ‘হাত গুটিয়ে’ বসে নেই, তা বিশ্বকে জানিয়ে নতুন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি নির্ধারণ এবং প্যারিস সম্মেলনে জলবায়ু চুক্তি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন বাংলাদেশের গণমানুষের এই নেতা। তাঁর নিবন্ধে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কোটি কোটি মানুষ পরিবেশ-উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে; যদিও গ্রিন-হাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণের কথা বিবেচনা করলে জলবায়ুর এই পরিবর্তনে বাংলাদেশের তেমন কোনো দায় নেই।’

ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নেতা পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছেন, ‘আর এ কারণে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নির্ধারণ এবং প্যারিসে জলবায়ু চুক্তি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই।’ তবে বিশ্ব এসে বাংলাদেশকে রক্ষা করবে এই আশায় আমরা হাত গুটিয়ে বসে যে নেই, সে কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘সম্পদ ও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার পরও নিজেদের ভবিষ্যত রক্ষায় আমরা লড়াই করে যাচ্ছি।’ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের নেতৃস্থানীয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে লেখা এক নিবন্ধে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বর্তমান শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় নাগাদ বিশ্বের সমুদ্র তীরবর্তী শহরগুলোর কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন। এ বিপর্যয় মোকাবেলায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তন ও মহামারি সম্মিলিতভাবে মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি ঐ নিবন্ধে বলেছেন, ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো নিঃসরণ না কমালে অন্য দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা অর্থহীন হয়ে পড়বে।’ জলবায়ু পরিবর্তন ও কভিড-১৯ মহামারি থেকে উদ্ভূত সংকট কার্যকরভাবে মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্ডিয়ানের ঐ নিবন্ধে আরো বলেছেন, উভয় ঝুঁকি প্রশমনে ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ দরকার।

জাতিসংঘের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে ভার্চুয়ালি দেওয়া বক্তব্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বিশ্ব বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘এই মহামারি আমাদের ২০৩০ এজেন্ডার লক্ষ্য অর্জনকে আরো কঠিন করে দিয়েছে। চলমান মহামারিসহ বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ ধরনের সংকট মোকাবেলার অক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে। এই মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে যে উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশকেই আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জাতিসংঘকে এখন বেশি প্রয়োজন।’

একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা সব সময় নিজেকে প্রমাণ করেছেন। জনগনের প্রতিনিধি তিনি, জনগণই তাঁকে বসিয়েছে নেতৃত্বের আসনে। জনগণের মনের কথা তিনি বুঝতে পারেন সহজেই। নিজেকে অন্যদের মতো শাসক না ভেবে সেবক হিসেবে ভাবতে পেরেই তিনি তৃপ্ত। তাঁর চিন্তা ও চেতনায় কেবলই বাংলাদেশ ও দেশের মানুষ। তাঁর নেতৃত্ব বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ।

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিনে। জন্মদিনে তাঁকে জানাই আন্তুরিক অভিনন্দন। দীর্ঘজীবী হোন তিনি। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী হয়ে নেতৃত্বের হাল ধরে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁর বিকল্প নেই।

লেখক: সভাপতি, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও লেখক
nazrul@gmx.at

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...