যেভাবে বিক্রি হয়েছিলেন বাংলাদেশি দুই নারী

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ১৫ অক্টোবর ২০২০, ৬:৫১ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অসংখ্য মেয়ে ভারতসহ বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে পাচার হয়ে যায়। এরপর তাদের বিক্রি করা হয় বিভিন্ন গণিকালয়ে। এই বৃহস্পতিবারও ভারতের মহারাষ্ট্রের থানে শহর থেকে এমন তিন বাংলাদেশি নারীকে উদ্ধার করেছে সেখানকার পুলিশ। একই দিন ব্রিটেনের বিখ্যাত টেলিভিশন চ্যানেল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক তাদের একটি প্রতিবেদনে দুই বাংলাদেশি নারীর পাচার হওয়ার যন্ত্রণার গল্প তুলে ধরেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিনে দিনে বাংলাদেশ এবং ভারত এই অবৈধ বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠছে।

যাদের গল্প তুলে ধরা হয়েছে তাদের একজনের বাড়ি খুলনায়। আরেকজনের নারায়ণগঞ্জে। প্রতিবেদনে খুলনার মেয়েকে সায়েদা হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের জনকে বলা হয়েছে ‘স’

জিওগ্রাফিক লিখেছে, ‘অপরিচ্ছন্ন পাড়ায় দুই কামরার বাড়িতে বেড়ে ওঠা সায়েদা, তার শৈশবের বেশির ভাগ সময়টা একাই কাটিয়েছে। অনেক সকালে তার মা বেরিয়ে যেতেন। তিনি খুলনার অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র নিউ মার্কেটে দোকান সাফাইয়ের কাজ করতেন। সায়েদার বাবা রিকশা চালাতেন। সামান্য পয়সার বিনিময়ে সওয়ারি পৌঁছানো ছিল তার কাজ।’

‘পড়াশোনায় তেমন সুবিধা করতে না-পারা সায়েদা ১৩-তে পৌঁছানোর আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়। বকুনি দিয়ে মা বলেছিলেন, এর ফলে মুশকিলে পড়বে সে।’

‘মিশুকে, খোলামেলা স্বভাবের, হাসিখুশি সায়েদা যেকোনো কারও সঙ্গে চটপট বন্ধুত্ব পাতাতে পারত। সে সবচেয়ে ভালোবাসত নাচতে। বাবা-মা যখন বেরিয়ে যেতেন, তখন টেলিভিশনে হিন্দি আর বাংলা সিনেমার নাচের দৃশ্যগুলো দেখে দেখে নকল করত সায়েদা। মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলে বকুনি খেতে হতো।’

প্রতিবেদনটির লেখক যুধিজিৎ ভট্টাচার্যকে সায়েদার মা জানিয়েছেন, তার মেয়ে যে সব সময় নাচ-গান করত, প্রতিবেশীরা তা ভাল চোখে দেখতেন না। তার কথায়, ‘আশপাশের লোকজন ওকে খারাপ বলতো।’

‘সুন্দরী সায়েদা ছিল পাথরে কোঁদা মসৃণ মুখ আর টানা বড় চোখের একটি মেয়ে। সে সাজতে ভালোবাসত। এক সময় সে বিউটি সেলুনে হেয়ারস্টাইল, ত্বক-পরিচর্যা আর প্রসাধনী ব্যবহারের শিক্ষানবিশ শুরু করল। তাদের মেয়ে এলাকার ছেলেদের আকর্ষণের কারণ হয়ে উঠছে দেখে উদ্বিগ্ন বাবা-মা ১৩ বছরেই তার বিয়ে দিয়ে দিলেন। ’

‘বেআইনি হলেও বাল্যবিবাহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু জায়গাতেই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু বাবা-মা যে ছেলেকে পছন্দ করেছিলেন, সে সায়েদার উপর অত্যাচার করত।এক সময় বাধ্য হয়েই বাপের বাড়ি ফিরে এল সায়েদা।’

‘বাড়িতে ফিরে আসার পর নাচের স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য মায়ের কাছে আবদার করল সায়েদা। সে তার মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, ‘আমি নাচের অনুষ্ঠান করে বাড়ির জন্য কিছু রোজগার করতে পারব।’

‘শেষ পর্যন্ত রাজি হন মা, আর সায়েদা তার পর বিয়েবাড়ি-সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচতে শুরু করল। এই সময়েই সে প্রেমে পড়ে। ছেলেটি তার নাচের স্কুলে মাঝে মাঝেই আসত। একসময় সে সায়েদাকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। স্বপ্ন দেখায়,সেখানে গেলে সায়েদা আরও অনেক বেশি রোজগার করতে পারবে। সায়েদার সামনে এক সম্ভাবনাপূর্ণ ভবিষ্যতের ছবি ভেসে ওঠে। ছেলেটির সঙ্গে পালানোর ব্যাপারে সে মনস্থির করে ফেলে।’

আর নারায়ণগঞ্জের মেয়ে ‘স’ বাড়ি ছেড়ে ছিল চাকরির লোভে। তার পরিবারের পরিচিত এক জন তাকে ঢাকায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি ‘স’ –কে তুলে দেন অন্য এক জনের হাতে। তার মাধ্যমে ‘স’ পাচার হয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গে।

সেখান থেকে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় মুম্বাইয়ের একটি যৌনপল্লিতে। সেখানে দু’বছর থাকার পরে পুলিশ ‘স’-কে উদ্ধার করে। তাকে পাঠানো হয় একটি আশ্রয় শিবিরে। মাস ছয়েক বাদে ‘স’-এর সঙ্গে এক মহিলার দেখা হয়। তিনি ‘স’-কে প্রতিশ্রুতি দেন, বাংলাদেশে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু এ বারও প্রতিশ্রুতিভঙ্গ। ওই মহিলা ‘স’-কে বিক্রি করে দেন পশ্চিমবঙ্গের নামখানার একটি গণিকালয়ে। পরবর্তী সময় তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়ার পরে ‘স’ কিছু দিন ‘স্নেহ’নামক একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ছিল। এখন সে প্রাপ্তবয়স্কা।

প্রতিবেদনে এক ভারতীয় মেয়ের কথাও বলা হয়েছে, ‘এক জোড়া উজ্জ্বল চোখের লাবণ্যময়ী মেয়ে অঞ্জলি। তার পরিবার থাকত বস্তিতে, একটা কোনোমতে তৈরি করা ঘরে। লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করা মায়ের কাছেই সে মানুষ হচ্ছিল। এতই গরিব ছিল তারা যে, স্কুলের জন্য তাদের সাধ্যমতো কেনা জিনিসের অধিকার নিয়ে অঞ্জলির প্রায়ই বোনের সঙ্গে ঝগড়া হত।’

‘ভারতে গরিব ঘরের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে যেমন হয়, ১৩ বছর হওয়ার আগেই স্কুল ছাড়তে হয়েছিল অঞ্জলিকে। এর পরে একটি স্ন্যাক প্যাকেজিং কারখানায় সে কাজ নেয়। স্বল্পবাক অঞ্জলির বেশি বন্ধু ছিল না। তবে বাড়িতে তার প্রাণের বন্ধু ছিল পোষা একটি ছাগলছানা। সবসময় অঞ্জলির পায়ে-পায়ে ঘুরে বেড়াত সে, তার খাবার থেকে খুঁটে খেত, এমনকি, রাতে তার বিছানাতেও শুতো।’

‘এ দিকে কারখানায় আলাপ হওয়া একটি ছেলে অঞ্জলিকে মুগ্ধ করেছিল। সে জানত মা তার বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ করছেন। কিন্তু অঞ্জলি ঠিক করে, তার ভালবাসার পুরুষের সঙ্গেই জীবন কাটাবে। সেই মতো, ২০১৬ সালের অক্টোবরে দুর্গাপুজোর সময় এক বিকেলে নতুন, উজ্জ্বল রঙের একটি সালোয়ার কামিজ পরে চুপিসারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে। তারপর প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে বাস ধরে সোজা রেলস্টেশন। সেখানে ছেলেটির সঙ্গে অন্য একটি যুবককে দেখে একটু অবাকই হয়েছিল অঞ্জলি। কিন্তু প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে সে তাদের সঙ্গে কলকাতার ট্রেনে উঠে বসল।’

‘সেই বিকেলে হন্যে হয়ে অঞ্জলিকে খোঁজার সময় তার মা জানতে পারলেন যে, কিছুদিন ধরেই তার মেয়ে অন্য কারও সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ছক করছিল। অঞ্জলি উধাও হয়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে তাদের প্রতিবেশীরা শুনতে পেয়েছিলেন সে তার পোষা ছাগলছানাকে বলছে, ‘রামু, আমি তো চলে যাব, তোকে তো দেখার কেউ থাকবে না। মা কাজে যায়, দিদিরও বিয়ে হয়ে যাবে। তোকে কে দেখবে?’

নিজেদের কাহিনি বলা সায়েদা এবং অঞ্জলি এ রকম অগণিত দুর্ভাগ্যপীড়িত মেয়েদের মধ্যে মাত্র দু’জন। অপরাধ জগতের বেশিরভাগ অবৈধ ব্যবসার মতো এ ক্ষেত্রেও উৎপীড়নের মাত্রা বোঝা কার্যত অসম্ভব। কিন্তু এটা স্পষ্ট, পতিতাবৃত্তিতে নামানোর জন্য পৃথিবী জুড়ে নাবালিকাদের পাচার করার যে ব্যবসা, তার পেছনে লেনদেন হয় কয়েকশো কোটি ডলার।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের করা একটি বহুল ব্যবহৃত সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধু ২০১৬ সালেই ১০ লাখের বেশি শিশু যৌন ব্যবসার শোষণের শিকার। যেহেতু এই ব্যবসায়ে শিশুদের কাজে লাগানোকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন, ওই প্রতিবেদনে মেনে নেওয়া হয়েছে যে, প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও অনেক বেশি।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাচারের শিকার হওয়াদের কখনোই চিহ্নিত করা যায় না!

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...