বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি জিয়া

পচাঁত্তরের পনেরই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাস খানেকের মধ্যেই বিদ্রোহী অফিসারদের কর্মকান্ডে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। আর এই বিদ্রোহীরা জিয়াউর রহমানকে সেনা প্রধান করায় তাদের প্রতি দুর্বল ছিলেন জিয়া। এ কারণে সেনা চেইন অব কমান্ড ভঙ্গকারী খুনী অফিসারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পেতেন না তিনি। তিনি এদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেননি।

শুধু তাই নয় সেই সময় কয়েকজন সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের নির্যাতন করে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগও আসে। তারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে কিছু মূল্যবান জিনিস পত্রও হাতিয়ে নেয়। আগস্ট হত্যাকান্ডের অন্যতম হোতা মেজর (বরখাস্ত) বজলুল হুদাও এই লুটপাটে জড়িত ছিলেন।

হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম তার ‘সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাত্ত্ব পঁচাত্তর’ বইতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছেন। গ্রন্থটি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। হাফিজ উদ্দিন একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ এবং সাবেক মন্ত্রী।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া এবং সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ভেতর থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তার। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী । এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠা এক গণবাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনা পঁচিশেক অফিসার একাত্তরে মার্চে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জনযুদ্ধে শামিল হন। মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন তাদের একজন। পঁচাত্তরে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপদগামী সদস্যের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। ভেঙ্গেপড়ে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড। হাফিজ উদ্দিন আহমদ এর এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থে তাঁর নির্মোহ বয়ানে উঠে এসেছে সেইসব চিত্র।

হাফিজ উদ্দিন লিখেন, মাসখানেকের মধ্যেই বিদ্রোহী অফিসারদের কর্মকান্ডে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। কয়েকজন অফিসার আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের রেডিও স্টেশনে ধরে এনে নির্যাতন করে এবং তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবিদুর রহমানকে নির্যাতনের পর কয়েকটি চেক লিখিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়। এছাড়া আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতারাও তাদের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হন। তোফায়েলের সহকারী একান্ত সচিব মিন্টুকে রেডিও স্টেশনে পিটিয়ে হত্যা করে তার লাশ গুম করে ফেলা হয়।’

এই লুটেরাদের তালিকায় বজলুল হুদাও ছিলেন। পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাড়ি থেকে মূল্যবান জিনিসপত্রও হাতিয়ে নেয় খুনিরা । হাফিজ লিখেন, ‘দু-একজন অফিসারও সৈনিক ৩২ নম্বরে রাষ্ট্রপতির বাড়ি থেকে কিছু মূল্যবান জিনিসপত্রও হাতিয়ে নেয়। সেনা সদরের অফিসার মেসে বজলুল হুদার কাছে শেখ কামালের স্ত্রীর একটি স্বর্ণমুকুট দেখে তরুন অফিসাররা তাকে নানা প্রশ্ন করে। যার সদুত্তর সে দিতে পারেনি। এছাড়াও বিদ্রোহী অফিসাররা মাঝে মধ্যে সরকারের সচিবদের বঙ্গভবনে ডেকে এনে নানা ধরনের নির্দেশ জারি করতে থাকে, যেটি সম্পূর্ণরুপে তাদের এখতিয়াবহির্ভুত। ফলে সরকারি অফিসারদের মনেও একধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে এসব অফিসারদের বিরুদ্ধে সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে অভিযোগ জানানোর পরেও তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি কিংবা ব্যবস্থা গ্রহণের নামে কালক্ষেপণের কৌশল নিতেন। এসময় মেজর (বরখাস্ত) শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ উঠে। শাহরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার স্ত্রীর সঙ্গে অশালীন আচরন করেন।এছাড়াও ট্যাংক রেজিমেন্টের বলে বলীয়ান হয়ে বিদ্রোহী অফিসাররা নানা ধরনের অপকর্ম করে যাচ্ছিলেন। কর্ণেল শাফায়াত নির্দেশ পেলে দুইদিনের মধ্যে ট্যাংক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন জানালে জিয়া তাকে আরও দু-তিনমাস অপেক্ষা করতে বলেন।

এর আগে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে খুনী সেনা অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বঙ্গভবনে তিনটি ট্যাংক রেখে বাকি সব ট্যাংক সেনানিবাসে ফিরিয়ে আনার জন্য জিয়াউর রহমান নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু ফারুকের নেতৃত্বাধীন ট্যাংক রেজিমেন্ট এ আদেশ অমান্য করে। মুখরক্ষার খাতিরে সেনাপ্রধান জিয়া সাত দিন পর সেই আদেশ বাতিল করেন।

হাফিজ উদ্দিন লিখেন, ‘সেনা চেইন অব কমান্ড ভঙ্গকারী বিদ্রোহী অফিসারদের কর্মকান্ডে সেনা প্রধান জিয়াউর রহমান প্রায়শ বিব্রত ও অসন্তুষ্ট হতেন। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়ার সাহস পেতেন না। ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড সবার জন্যই ভীতিকর ছিল। এছাড়া বিদ্রোহীরা তাকে সেনাপ্রধান বানিয়েছেন, এজন্য তিনি তাদের প্রতি কিছুটা দুর্বল ছিলেন।

সূত্র : বাসস।

[১] [২] [৩]