বেদনার মাস শোকাবহ আগস্ট

প্রসেনজিৎ চন্দ্র শীল,

  • প্রকাশিত: ২১ আগস্ট ২০২২, ১:২১ অপরাহ্ণ

বাঙালি জাতির জন্য নিষ্ঠুরতম মাস। কান্নার মাস। বেদনার মাস। শোকাবহ আগস্টে বাঙালি জাতি হারিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার অঙুলির নির্দেশে গোটা বাঙালি জাতি একাত্তরে ‘যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা। সেই তাঁকেই কি না জীবন দিতে হলো এ দেশেরই কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে, যা ছিল কল্পনারও অতীত। শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেই শান্ত হয়নি শত্রুপক্ষ। এ মাসেই তার সুযোগ্যা কন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, গ্রেনেড হামলা করে তাকে মারার চেষ্টা করা হয়। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও অনেক নেতাকর্মীকে ওইদিন জীবন দিতে হয়।

একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সর্বাধিক অবদান ও আত্মত্যাগ যে মহামানবের, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিজের জীবনের সর্বস্ব বিলীন করে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও যিনি অবিচল চিত্তে শিল্পে উন্নত করে বাংলাদেশকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির জনক, বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তবে কেবল দেশ স্বাধীন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেন বিরাট মহাযজ্ঞ, পালন করেন আরেক ঐতিহাসিক মহান দায়িত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে এবং উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদানের একটি চিত্র তুলে ধরা হলো বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সাহারা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিব। বাবা-মা ডাকতেন খোকা বলে। খোকার শৈশবকাল কাটে টুঙ্গি-পাড়ায়।

শেখ মুজিবুর রহমান কেবল একজন ব্যক্তির নাম নয়, তিনি নিজেই এক অনন্যসাধারণ ব্যতিক্রমী ইতিহাস। সমাজ, দেশ ও কালের প্রেক্ষাপটে তিনি ব্যক্তি মুজিব থেকে হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক নেতা থেকে হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহানায়ক। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি বাঙালির অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে ভারত বিভাজন আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শুরুতে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি, এরপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে মুজিবকে বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ গণ্য করা হয়।

দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের নেপথ্যের কারিগর বঙ্গবন্ধুর ডাকেই সমগ্র বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে। তার হাত ধরেই ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে প্রথমবারের মতো অঙ্কিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে তার নাম লেখা হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিরূপে। একজন সম্মোহনী নেতা এবং জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু ব্যাপক ত্যাগ স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য, নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নতুন দেশ নিয়ে তার ভিশনের কথা বলেছেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বাংলাদেশকে মুক্ত করার যাত্রাকে তিনি সেদিন বর্ণনা করেন ‘বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতা, নিরাশা থেকে আশার’ যাত্রা হিসেবে। সেদিন তিনি আরো বলেছেন, স্বাধীন দেশে ফিরছেন হৃদয়ে কারো প্রতি কোনো ঘৃণা নিয়ে নয়। বরং তিনি ফিরছেন পরম সন্তুষ্টি নিয়ে যে অবশেষে মিথ্যার বিপরীতে সত্য, উন্মত্ততার বিপরীতে সুবিবেচনা, কাপুরুষতার বিপরীতে সাহস, অন্যায়ের বিপরীতে ন্যায় এবং মন্দের বিপরীতে ভালোর জয় হয়েছে।

একজন রাষ্ট্রনায়ক, অবিশ্বাস্য বাগ্মী বঙ্গবন্ধু খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগে বিপুলভাবে অভিভূত হয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ জানুয়ারি দেয়া ভাষণে তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপের কথা বলেন এবং বাংলাদেশের বিজয়ী জনগণের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন। প্রথম সুযোগেই তিনি কাউকে অবাঙালিদের ওপর হাত না তুলতে সতর্ক করেন। একই সঙ্গে পাকিস্তানে আটকা পড়া চার লাখ বাঙালির নিরাপত্তার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সাধারণ পাকিস্তানিদের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ নেই, সেটা যেমন নিশ্চিত করেছেন, তেমনি পরিষ্কার করে বলেছেন, অন্যায়ভাবে বাঙালিদের যারা হত্যা করেছে তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।

সাড়ে তিন বছর নির্ঘুম থেকে সরকার পরিচালনা করেছেন তিনি। এই অল্প সময়ের প্রতিটি দিন একের পর এক সংস্কারমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে শুধু এই সময়ের সরকারি প্রকল্প বা সিদ্ধান্তের নিক্তিতে মাপতে যাওয়া সমীচীন হবে না। কারণ রাজনীতিবিদ এবং ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা, আদর্শিক সংগ্রাম, কষ্ট স্বীকার ও আত্মত্যাগ বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। একটি পরাধীন জাতির স্বাধীনতা অর্জনে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুকে আজীবন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে প্রাতঃস্মরণীয় করে রাখতে এই একটি কারণই যথেষ্ট।

কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ এবং ভয়াবহতা ছিল অবর্ণনীয়। তা অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না। মাত্র এক বছরের মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম সুলিখিত সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন জাতিকে। রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ, জাতীয় প্রতীক প্রণয়ন, রাষ্ট্র পরিচালনার কার্যপদ্ধতি ও কার্যবণ্টন প্রণয়ন করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন গঠন, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। নবগঠিত পরিকল্পনা কমিশনে একই রকমভাবে দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, প্রকৌশলী এবং অন্যান্য পেশাজীবী সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

কিন্তু স্বাধীনতার কয়েক বছর পর একদল অকৃতজ্ঞ বাঙালি নৃশংসভাবে হত্যা করে জাতির পিতাকে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর তিন ছেলে- শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, তার সহধর্মিণী আরজু মণিসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন।

এতো হত্যার পরেও শত্রুপক্ষের রক্তের পিপাশা থেমে থাকেনি। শেখ পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে এবার টার্গেট করা হয় শেখ হাসিনাকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জাতির জনকের কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড ছুড়ে হত্যার চেষ্টা হয়। বিধি বাম থাকায় ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও এ ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী, আওয়ামী লীগের সেই সময়ের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং ৫ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছিলেন। এখানে বলতেই হয় আল্লাহ যাকে রক্ষা করবেন মারার ক্ষমতা কারো থাকে না। দেশ-জাতি ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। আল্লাহ তাঁকে হায়াত-দরাজ করেছেন।

বাংলাদেশের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেঁচে থাকাটা বড় প্রয়োজন, যিনি লড়ছেন বিষভধৎব ভড়ৎ ধষষ-এর জন্য, যিনি লড়ছেন একটি মঙ্গলরাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য। আগস্ট আমাদের শোকের মাস, যে শোক থেকে পুনর্জন্ম হয়েছে শক্তির, আর শক্তি থেকে জাগরণ, জাগরণ থেকে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ। সুতরাং এ মাসে আমাদের সজাগ থাকতে হবে, সচেতন হতে হবে, সোচ্চার হতে হবে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে এবং সকল মঙ্গলের পক্ষে। আর যেন রচিত না হয় কোন নয়া আগস্ট। আর যেন কোন কালো ভোর বাঙালীর সম্ভাবনার সূর্যকে গ্রাস করে ফেলতে না পারে। আর যেন আমাদের শোক ও গ্লানির অতলে হারিয়ে যেতে না হয়। এই প্রত্যাশা আজ সমগ্র জাতির।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ। prashenjithrohit@gmail.com

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...