সিত্রাংয়ে তছনছ উপকূল : ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২২, ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ

সোমবার আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। সেই ঝড়ের ঝাপটা লাগে দেশজুড়ে। ১১০ কিলোমিটার গতিবেগের সিত্রাং উপকূলজুড়ে তাণ্ডব চালায় মধ্যরাত পর্যন্ত। ভোরে দুর্বল হয়ে সিলেট পেরিয়ে ভারতের দিকে যায়। তবে পার হওয়ার সময় তছনছ করে দিয়ে যায় উপকূল। অমাবস্যা রাতে ভয়াবহতা টের পাওয়া গেলেও স্পষ্ট হয়নি ক্ষত। ভোরে রৌদ্রোজ্জ্বল আলো ফুটতেই বেরিয়ে আসে রাতের ধ্বংসযজ্ঞের চেহারা। তবে ঝড়ের সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র এখনও হিসেব করা হয়নি।
এদিকে, সব মিলিয়ে সিত্রাং কেড়ে নিয়েছে ৩৮ জীবন। বিধ্বস্ত হয় ঘরবাড়ি, উপড়ে যায় গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটি, ভেসে গেছে ঘেরের মাছ, ডুবেছে ক্ষেতের ফসল। সবচেয়ে বেশি আঘাত আসে কৃষকের ঘামে ভেজা স্বপ্নের ফসলে। আধাপাকা আমনে মই দিয়েছে সিত্রাং। আমন ছাড়াও মাঠে থাকা বিভিন্ন ধরনের সবজি, পান, কলা ও পেপে বাগানেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে কৃষি বিভাগ ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগহের পাশাপাশি পানি সরে যাবার পড়ে ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপন করবে বলে জানা গেছে। ফলে এ মূহূর্তে ঠিক কত টাকার ফসলহানী বা ক্ষতি হয়েছে তা জানাতে পারছেনা কৃষি বিভাগ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তাৎক্ষণিক তথ্য বলছে, ৫৮ হাজার ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের ভাষ্য, ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কার চেয়ে কম হয়েছে। ১০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। মৎস্য ঘের ভেসে গেছে ১ হাজার।
অপরদিকে সিত্রাং-এ ভর করে প্রবল বর্ষণ সহ স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট উচ্চতার জোয়ারে দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য সেক্টরেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সিত্রাং-এর প্রবল বর্ষণ ও জোয়ারে দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় দেড় হাজার হেক্টরের ১২ হাজারেরও বেশী পুকুর, দিঘি ও মাছের ঘের প্লাবিত হয়ে প্রায় ১৮ টন মাছ, ৭১ লাখ পোনা ভেসে যাওয়া ছাড়াও ৫৫টি মাছধরা নৌকা ও ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে।
বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে মাছ আর পোনা ভেসে যাওয়ায় এ অঞ্চলের অনেক মৎস্যজীবী সর্বশ^ান্ত হয়ে গেছে। মৎস্য সেক্টরে বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালীতেই সর্বাধিক পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
অপরদিকে প্রাণি সম্পদ সেক্টর থেকেও যথেষ্ট দুঃসংবাদ পাওয়া গেছে। সিত্রাং-এর তান্ডবে দক্ষিণাঞ্চলের ৪২ উপজেলার ২০৯টি ইউনিয়নে গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগির খামারের ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং নিয়ে পূর্বাভাস ছিল ১ অক্টোবর। তারপরও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রস্তুতি ছিল নড়বড়ে। পূর্বাভাস, সতর্কবার্তা পৌঁছানো ও আগাম প্রস্তুতিতে ছিল ঘাটতি। একেক সময় দেওয়া হয়েছে একেক বার্তা। প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের বাংলাদেশে সিত্রাং আঘাত হানার তথ্য নিয়েও শেষ মুহূর্তে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। যদিও সোমবার তিনি তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যেও ছিল গরমিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, শুরু থেকেই সিত্রাংয়ের আচরণ ছিল এলোমেলো। বারবার পাল্টাতে থাকে গতিপথ। তাই এর গতিবিধি ঠিকমতো বোঝা যায়নি। আসার পথে বৃষ্টি ঝরিয়ে নিজের শক্তি ক্ষয় করেছে।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় হিসেবে গঠিত হওয়ার আগে নিম্নচাপের সময়ই এটি তিন অংশে ভাগ হয়ে যায়। আর বারবার পাল্টেছে গতিপথ। প্রথমে ভারতের উড়িষ্যা, পরে পশ্চিমবঙ্গ এবং শেষে বাংলাদেশের উপকূলমুখী হয়েছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরও সোমবার পর্যন্ত একে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বলেছে। তবে আসার পথে এটি প্রবল বৃষ্টি ঝরায়। তাতে এর শক্তিক্ষয় হয়। তাই এটি দ্রুত এসে দ্রুতই চলে যায়। রাত ১টার মধ্যেই উপকূল মোটামুটি পরিস্কার হয়ে যায়। ছয় ঘণ্টার মধ্যে এটি হয়ে পড়ে শক্তিহীন।
এদিকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের পরদিন জানিয়েছিলেন, মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন। বুধবারের মধ্যে সব বিচ্ছিন্ন সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে বুধবার পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের আওতায় থাকা ৯৪ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন ঘূর্ণিঝড়ের রাতে, যার মধ্যে বুধবার সকাল পর্যন্ত ৮০ লাখ গ্রাহকের সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়েছে।
তবে অনেক জায়গায় এখনো ফেরেনি বিদ্যুৎ সংযোগ। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, বিদ্যুৎ সংযোগের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী এবং লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা।
কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের আওতায় থাকা ৯৪ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন ঘূর্ণিঝড়ের রাতে। কর্মকর্তারা বলছেন ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ে, গাছ পড়ে এবং বৈদ্যুতিক সংযোগের তার ছিঁড়ে দেশের বহু শহর, পৌরসভা এবং গ্রাম এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় এখনো ফেরেনি বিদ্যুৎ সংযোগ।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে দেশের চার বিভাগের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন সরকারি ও বেসরকারি এ সকল ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাঠাতে আঞ্চলিক প্রধানসহ উপজেলা বা থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...