দায়মুক্তির অধ্যাদেশ: কালো আইনে বন্দি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০২২, ৮:১৪ অপরাহ্ণ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রাতের অন্ধকারে গুলি করে খুন করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের ১৭ জনকে। যা বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়। সেই হত্যাকারীদের রেহাই দিতে জারি করা হয়েছিল দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। এ দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি জারি করেন তখনকার অবৈধ সরকারপ্রধান খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর।

এরপর ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই অধ্যাদেশটিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে অপরাধীদের দায়মুক্তি পাকাপোক্ত করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

আইনটির মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু এবং জেলহত্যার তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া আটকে রাখা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ছাড়াও এই দুই যুগেরও বেশি সময়ে যেসব সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা বিভিন্নভাবে হত্যাকারীদের সহায়তা ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে।

১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আইনটি বাতিল করলে খুনিদের বিচারের পথ খুলে যায়।

দায়মুক্তির অধ্যাদেশে ছিলো এমন- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা-ই কিছু ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশ বলছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। মোশতাকের পর অধ্যাদেশে সই করেন তখনকার আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমান।

অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি পদে বসানো হয়েছিল মোশতাককে। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের হাতে চলে যাওয়ার কথা। কোনো আইন কিংবা অজুহাতে রাষ্ট্রপতি হওয়ার অধিকার ছিল না মোশতাকের। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী। কাজেই তার রাষ্ট্রপতি হওয়া সংবিধান সমর্থিত না। এ কথা পরিষ্কার যে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার যোগসাজশ ছিল।

ঘাতকেরা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গৃহবন্দি করে। এরপর বিনাবিচারে আটকে রাখে জেলখানায়। তোফায়েল আহমেদসহ কয়েকজনের ওপর শারীরিক নির্যাতনও চালানো হয়।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে একই বছরের ১২ নভেম্বর ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ বিলের মাধ্যমে দায়মুক্তির অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়। এতে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচারের বাধা দূর হয়।

১৯৯৬ সালে দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিলের আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের তখনকার সচিব আমিন উল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি সিদ্ধান্ত দেয়, এটি বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই। দায়মুক্তি অধ্যাদেশের মতোই প্রায় ১৬টি আইন পঞ্চম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা হয়। কাজেই এটিও একই রকমভাবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সংসদে বাতিল করা সম্ভব।

কমিটির এই প্রতিবেদন আইন কমিশনের মতামতের জন্য পাঠানো হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এফ কে এম মুনীমের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনও তা সমর্থন করে। এরপর তখনকার আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ বিলটি সংসদে তোলেন। পরে ওই বছরের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ সংসদে আইনটি পাস হয়। মোট ২০ জন আসামির বিরুদ্ধে ঢাকার দায়রা জজ আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। এভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ খুলে যায়।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...