বিশ্বকাপের কালো ম্যাচ

শিমুল খালেদ,

  • প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ

মাত্র কয়েক ঘন্টা পরই শুরু হচ্ছে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মহারণ! ফুটবল বিশ্বকাপের প্রায় শত বছরের ইতিহাসে আলোড়িত কয়েকটি ম্যাচ লিখতে চেষ্টা করেছি। যদিও ঘটনাগুলো ফুটবলের সৌন্দর্যের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। ফিচারটি পাঠকের মনে ধরলে কলম ধরা সার্থক।

পুরো দুনিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলে মাতোয়ারা! আজ প্রথম সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে মোকাবেলা করবে আর্জেন্টিনা। বিশ্বের সবচেয়ে জমকালো, আলোচিত ও জনপ্রিয় ক্রীড়া আসর; বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা কতৃক আয়োজিত এই বিশ্বকাপ ফুটবল। আর তাই তো গ্রহের সবচেয়ে সাড়া জাগানো এই আসরকে ডাকা হয় ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ নামে। বিশ্বকাপের ২২তম এই আসরে বিশ্বের বাঘা বাঘা ফুটবলাররা তাদের ক্রীড়ানৈপূণ্যে মাতিয়ে রাখবে সারা বিশ্বের ফুটবল প্রেমীদের। কিন্তু চাঁদেরও যেমন কলঙ্ক আছে, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই আসরের ইতিহাসেও তেমনি যুক্ত হওয়া ফুটবলের সুন্দর বিনোদন চেতনার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কয়েকটি ম্যাচ প্রতিযোগিতাটির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। তেমনই কিছু ম্যাচের কথা আজ তোলে ধরলাম।

ব্যাটেল অফ মিউনিসিপ্যাল:
১৯৩৮ সাল। ফুটবল বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর। ফ্রান্সের জোন্সের মিউনিসিপ্যাল স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছে তৎকালীন ফুটবল বিশ্বের দুই জায়ান্ট ব্রাজিল আর চেকোস্লাভিয়া। জয়ের বিকল্প নেই কারো সামনে। শেষ চারে অথাৎ সেমিফাইনালে ওঠতে হলে দুই দলেরই চাই জয় জয় এবং জয়। রেফারী বাঁশিতে ফুঁ দেয়ার পর পরই বল দখলের জন্য ফুটবল রীতি নীতি ভেঙ্গে উভয় দল ঝাপিয়ে পড়ল একে অপরের ওপর। খেলাটা আর খেলার পর্যায়ে নেই রীতিমত মল্লযুদ্ধ বলা যায়। রেফারী হার্নকার দূর্বল রেফারিং এর সুযোগে বল রেখে যে যার পায়ে পারে লাথি মারছে। বল পায়ে এগিয়ে যাওয়া নেজলিকে ভয়ঙ্করভাবে ট্যাকল করল ব্রাজিলের রাইটব্যাক জেজে। লাথির তীব্রতায় নেজলির পা ভেঙ্গে যায়। রেফারি সাথে সাথে জেজেকে লাল কার্ড দেখিয়ে বহিষ্কার করেন। খেলার ত্রিশ মিনিটের মাথায় ব্রাজিল লিওনিডাসের গোলে এগিয়ে যায়। এর পরপরই মারামারি মারাত্মক আকার ধারণ করে। বল ছেড়ে চেকের রিহা আর ব্রাজিলের ম্যাচাডোসের মধ্যে শুরু হলো ঘুষাঘুষি। মনে হলো তারা ফুটবল নয় মুষ্টিযুদ্ধ খেলছেন! কিংকতব্যবিমূঢ় রেফারি সাথে সাথেই দু’জনকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ ছাড়া করেন। বিরতির পর খেলার ষাট মিনিটের মাথায় ব্রাজিলে ডোমিঙ্গাস মারাত্মক ফাউল করে বসলেন একজন চেক ফরোয়ার্ডকে। ফাউলের ধরণ দেখে দর্শকরা পর্যন্ত হতভম্ব! অথচ রেফারি তা এড়িয়ে গেলেন দেখেও না দেখার ভান করে। খেলার এক পর্যায়ে ব্রাজিলের একজন খেলোয়াড় গোলপোস্টের ভেতর হাত দিয়ে বল ধরায় রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজান। সফল পেনাল্টি গোলে চেকরা খেলায় ১-১ সমতায় ফিরে আসে। অতিরিক্ত সময়েও আর কোন গোল না হওয়ায় ম্যাচটি রিপ্লেতে চলে যায়। দু’দলের এই ফুটবল কাম পেশীযুদ্ধে চেকোস্লাভিয়ার ছয়জন এবং ব্রাজিলের নয়জন খেলোয়াড় আহত হয়। চেকের নেজলির পা ও প্লানিকার ডান হাত ভেঙ্গে যায়। ব্রাজিলের পেরাসি আর লিওনিডাস ও আহত হয়। মিউনিসিপ্যাল স্টেডিয়ামে এই ‘ভয়ঙ্কর’ ফুটবলযুদ্ধ সেদিন অবলোকন করেছিল প্রায় পঁচিশ হাজার দর্শক।

ব্যাটেল অফ বার্ন:
১৯৫৪ সাল। সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের পঞ্চম আসর। ২৭ জুন বার্ন স্টেডিয়ামে মুখোমুখি দুই তৎকালীন ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিল আর হাঙ্গেরী। শেষ চারে স্থান পেতে দু’দলের সামনেই একই রাস্তা- ডু অর ডাই! খেলার শুরু থেকেই উভয় দলের খেলোয়াড়েরা ভীষণ রকম স্নায়ুযুদ্ধে ভোগতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই স্নায়ুযুদ্ধ রুপ নেয় মল্লযুদ্ধে। খেলার মাঠ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। খেলার মাঠ থেকে সেই ‘যুদ্ধ’ ছড়িয়ে পড়ে ড্রেসিংরুম পর্যন্ত। জায়ান্ট হাঙ্গেরির একতরফা আক্রমণে ব্রাজিল তখন কোণঠাসা, দিশেহারা। শুরুই দিকেই সংঘবদ্ধ আক্রমণে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি। হিদেকুটির পর খেলার অষ্টম মিনিটের মধ্যেই হাঙ্গেরিকে আবারও কোসিজে এগিয়ে দিলে তারা এগিয়ে যায় ২-০ গোলে। তারপর পেনাল্টি বক্সের ভেতর হাঙ্গেরির একজন খেলোয়াড় ফাউল করলে পেনাল্টি পায় ব্রাজিল। স্যান্টোস এর সফল কিকে ব্যবধান কমায় ব্রাজিল (১-২)। বিরতির পর যার যার ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে ফিরে এসে উভয় দলের যেন পুরোদস্তুর মারমুখো হয়ে ওঠে। হাঙ্গেরির জিবর গোলপোস্টের সামনে ফাঁকায় দাড়ানো সতীর্থ কোসিজেকে পাস দিলেন। অপ্রতিরোধ্য কোসিজেকে রুখতে ব্যর্থ হয়ে হাত দিয়ে বল ঝাপটে ধরে প্রতিহত করলেন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার পিনহিরো। ফলস্বরুপ পেনাল্টি পেল হাঙ্গেরি। ল্যান্টোসের সফল কিকে ব্যবধান আরো বাড়ালো হাঙ্গেরি (৩-১)। আক্রমণ প্রতি আক্রমণের মধ্যে কয়েক মিনিটের ভেতর ব্যবধান কমালেন ব্রাজিলের জুলিনো (২-৩)। এরই মধ্যে দু’দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে হাতাহাতি ঘুষাঘুষি! হাঙ্গেরির বোজসিক বল ছেড়ে ঘুষি মারলেন ব্রাজিলের স্যান্টোসের নাক বরাবর। শুরু হল দুজনের মারামারি। আর্থার এলিস দুজনকেই লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠছাড়া করলেন। তারপর খেলার শেষ বাঁশি বাজার মাত্র দুই মিনিট বাকি। সতীর্থ জিবরের ক্রসে ঠিকমত মাথা ছোয়ালেন হাঙ্গেরির কোসিজে। সাথে সাথে সব অনিশ্চয়তার কপিনে পেরেক ঠুকে জয় নিশ্চিত করে ফেললেন (৪-২)। শেষ বাঁশি বাজার কয়েক সেকেন্ড থাকতেই ব্রাজিলের তোজ্জি কোন কারণ ছাড়াই লাথি মারলেন হাঙ্গেরির লরেন্ট কে। রেফারি তোজ্জিকে বহিষ্কার করলেন। খেলা শেষ। হাঙ্গেরি জিতে গেছে ৪-২ ব্যবধানে। তবুও হাঙ্গেরির খেলোয়াড়দের মনে প্রতিশোধস্পৃহা রয়ে গেছে। ড্রেসিংরুমে ঢুকার সময় হাঙ্গেরির পুসকাস ব্রাজিলের পিনহিরোর মুখে বোতল ছুড়ে মারলেন। পিনহিরোর মুখ মারাত্মকভাবে থেতলে গেল। প্রায় আট সেন্টিমিটার ক্ষতের সৃষ্টি হয় তার জখমে। পুসকাসের এই জঘন্য কান্ডে ফুঁসে ওঠল ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা। ড্রেসিংরুমের প্রবেশপথের আলো নিভিয়ে দিয়ে তারা ঝাপিয়ে পড়ল হাঙ্গেরির খেলোয়াড়দের ওপর। উভয়পক্ষে শুরু হল ভয়াবহ সংঘর্ষ। বিশ্বকাপ কমিটির সুইস প্রেসিডেন্ট আর্নস্ট থমেনের সামনেই ঘটে গেল এমন নৃশংস ঘটনা। নির্বিকার পুলিশ সদস্য সহ সেদিন এই ‘কালো ঘটনা’ অবলোকন করেছিল বার্ন স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৬৩,২০০ দর্শক। ম্যাচটির ভয়াবহতা আন্দাজ করে নিতে পারেন যে, রেফারি ৪২ বার ফাউলের বাঁশি বাজিয়ে ছিলেন! বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই ম্যাচটি স্বীকৃত হয়েছে ‘ব্যাটেল অব বার্ন’ নামে।

ব্যাটেল অব সান্টিয়াগো:
১৯৬২ সাল। দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের সপ্তম আসর। চূড়ান্ত পর্বের আসর শুরু হওয়ার কিছু দিন আগে মারাত্মক রকম প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে চিলি। প্রচন্ড ভূমিকম্পের ফলে চিলির অর্থনীতির মেরুদন্ডে ধস নামে। তারওপর বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির দূনীর্তিগ্রস্থ হওয়ার খবরও বাতাসে ভাসতে থাকে। চিলির এমন দৈন্য অবস্থা ইতালির মিডিয়া গুলোতে আরেকটু রংচঙে সাজিয়ে ফলাওভাবে প্রচার করা হয়। এর ফলে চিলি স্বভাবতই ইতালির ওপর দারুণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা দেশের মানুষ।
জুনের ২ তারিখ। সান্টিয়াগো স্টেডিয়ামে মুখোমুখি স্বাগতিক চিলি আর দ্ইু বারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি। কানায় কানায় ঠাসা স্টেডিয়ামের ৫১ হাজার ৮০০ দর্শক যেন মাঠে হাজির হয়েছে ইতালিকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে। খেলা শুরুর পর হঠাৎ ইংলিশ রেফারি আস্টনের পেছন থেকে চিলির ডিফেন্ডার সানচেজ ইতালির ফরোয়ার্ড ম্যাসিও’র নাকে বাঁ হাতে প্রচন্ড ঘুষি মারেন। রেফারি এমন ঘটনা দেখেও না দেখার ভান করে খেলা চালিয়ে যান। শুরু হতে না হতেই এমন ঘটনা উসকে দিল দু’দলের খেলোয়াড়দের। সাত মিনিটের মাথায় ইতালির ফেরিনি চিলির ল্যান্ডাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। শুরু হল প্রচন্ড রকম উত্তেজনা। ইতালির ডেভিড আক্রোশের মাথায় লাথি মারলেন চিলির সানচেজের মাথায়। শুরু হয় ঘুষাঘুষি লাথালাথি! রেফারি আস্টন তৎক্ষণাৎ ইতালির ফেরিনি ও ডেভিড দুইজনকেই লাল কার্ড দেখালেন। নয়জন নিয়েও অবশ্য মন্দ খেলছিল না ইতালি। তবে খেলার পচাত্তর মিনিটের মাথায় চিলির রামিরেজের গোলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাদের ডিফেন্স। এগিয়ে যায় চিলি। খেলার শেষ মিনিটে আবারও চিলির টোরোর দেয়া গোলে ম্যাচ জিতে নেয় চিলি ২-০ ব্যবধানে। গোলযোগপূর্ণ এই ম্যাচটি বিশ্বকাপ রেকর্ডসে ‘ব্যাটেল অব সান্টিয়াগো’ নামে খ্যাত।

ব্ল্যাক ম্যাচ :
সেই ১৯৩০ সাল। নানা পথপরিক্রমার পর সব প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে উরুগুয়েতে বসেছে বিশ্বকাপের প্রথম আসর। ম্যাচটির প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্র। ফেভারিট আর্জেন্টিনা প্রথম থেকেই সেদিন খেলায় ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিল। কুলিয়ে ওঠতে পারছিল না যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। তাই তাদের মধ্যে অখেলোয়াড়ছিত আচরণ মাথাছাড়া দিয়ে ওঠে। আশ্রয় নেয় নোংরা ফাউলের। খেলার দশম মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের টার্সি বল নিয়ে বিপজ্জনকভাবে ঢুকে পড়েন আর্জেন্টাইন রক্ষণ ভেদ করে। তার কাছ থেকে বল কেড়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে আর্জেন্টিনার একজন ডিফেন্ডার সজোরে লাথি মারেন টার্সির গায়ে। লাথির প্রচন্ডতায় সাথে সাথেই পা ভেঙ্গে যায় টার্সির। রেফারি তবু নির্বিকার! প্রথর্মাধের মাথায় আবারো আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের লাথির শিকার হয় যুক্তরাষ্ট্রের লেফট হাফ এন্ডি। এমনকি আহত হন যুক্তরাষ্ট্রের গোলরক্ষক জিমি। আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের রাফ ট্যাকলিংয়ের শিকার হয়ে আহত হন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশী খেলোয়াড়। অথচ রেফারি ল্যাঙ্গেনাসের চোখ তা সহজেই এড়িয়ে যায়। আর তাই ভাল প্রতিদ্বন্দিতা করেও তাদের ম্যাচটি হারতে হয় ৬-১ গোলের বড় ব্যবধানে। বিশ্বকাপ ফুটবলের রেকর্ডস বুকে এ ম্যাচটি ‘ব্ল্যাক ম্যাচ’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। এই ম্যাচটি দিয়েই বিশ্বকাপের কালো অধ্যায়ের সূচনা।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...