লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের ফ্যানে ঝুলিয়ে মুক্তিপণ চাওয়া হতো

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২, ১:২৪ পূর্বাহ্ণ

লিবিয়ায় তখন মধ্যরাত। হঠাৎ শরিফের বন্দিশালায় প্রবেশ করে এক যুবক। এসেই বন্দিশালার সবাইকে তাদের নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা শুরু করে। পরিচয় জানার পরে কয়েকটি ভাগে বন্দিদের আলাদা করে ফেলে। পরে তাদের কাছে ওই যুবক ১০ লাখ করে টাকা দাবি করে।

যারা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাদের হাত মুখ বেঁধে শুরু করা হয় নির্যাতন। প্রথমে তাদেরকে ঝোলানো হয় ফ্যানের সঙ্গে। তারপর প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে ঝোলান অবস্থায় বেদম প্রহার করা হয়। এক পর্যায়ে তাদের পরিবারের কাছে মোবাইলে কল করে ভিডিও কলে দেখানো হতো নির্যাতনের ভয়াবহতা। পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয়ে কিছুদিনের মধ্যে মুক্তিপণের টাকা পাঠায়। এর পরেই মিলে এসব বন্দিদের মুক্তি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্যাতন করা ওই যুবকের নাম আজিজুল হক নির্ঝর (২৭)। তিনি মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের চরনাচনা গ্রামের আবুল কালাম হাওলাদারের ছেলে। লিবিয়ায় পশ্চিমাঞ্চল শহর জোয়ারা ক্যাম্পের মাফিয়া শরীফ হোসেনের সহযোগী। তার দায়িত্ব ছিল বন্দিশালার বন্দিদের নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করা।

জাহাঙ্গীর শেখ (২৭) মুন্সিগঞ্জ জেলার মোল্লাকান্দি এলাকার সেলিম শেখ ও সানতারা দম্পত্তির সন্তান। লিবিয়ার বন্দিশালায় থাকাকালীন আজিজুল হক নির্ঝরের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হওয়া এক ভুক্তভোগী। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে স্থানীয় দালাল আলমগীর হোসেনের মাধ্যমে ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন লিবিয়ায়। সেখানে গিয়ে মাফিয়ার খপ্পরে পড়ে বন্দিশালায় এমন বিভীষিকাময় জীবন কেটেছে তার। পরে টাকার বিনিময়ে লিবিয়ার বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে হাইতেম নামের এক দালালের মাধ্যমে ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল পৌঁছেছেন ইতালিতে। দীর্ঘদিন ইতালির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।

ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর শেখ বলেন, ‘নির্ঝর এতোটাই নির্দয় ছিল যে, ও কাউকেই ছাড়তো না। চাচার বয়সী লোকজনকেও টাকার জন্য প্রচুর মারধর করতো। গলায় পাড়া দিয়ে, দাড়ি টেনে কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন চালাত। বন্দিশালায় জায়গায় জায়গায় রক্ত লেগে ছোপ ছোপ দাঁগ হয়ে গিয়েছিল। আমাকে করা নির্যাতন দেখে বাবা স্ট্রোক করে মারা গিয়েছিল। পরিবারের লোকজন আমার কাছে বাবার মৃত্যুর খবর গোপন রেখেছিল। পরে ইতালি গিয়ে আরেক দেশি ভাইয়ের থেকে জানতে পেরেছি। আমরা হয়তো ভুল করে এ পথে এসেছি। কিন্তু নির্ঝর বাঙালি হয়েও আমাদেরকে টাকার জন্য কি অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। প্রশাসনের কাছে আমরা এর বিচার চাই।’

আরেক ভুক্তভোগী মোস্তফা কামাল (৩০)। কক্সবাজার চকরিয়ার বাসিন্দা। ২০১৪ সালে লিবিয়া যাওয়ার পর থেকে সেখানেই রঙের কাজ করতেন। তাকে কাজে বের হওয়ার সময়ে ধরে নিয়ে যায় শরীফ হোসেনের লোকেরা। পরবর্তীতে একই ক্যাম্পে বসে নির্ঝর নির্যাতনের মাধ্যমে ১০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে নেয়। মোস্তফা কামাল বলেন, অন্ধকার রুমে খাবার পানি না দিয়ে অনেক কষ্ট দেওয়া হতো। মুক্তিপণের টাকার জন্য এতোটাই মেরেছে এখনও শরীরের দাগগুলো যায়নি। আমরা নির্ঝরের বিচার চাই।

মাদারীপুর সদর উপজেলার হোসনাবাদ এলাকার রাকিব ফরাজী নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, শরীফের ক্যাম্পে আমি বন্দি ছিলাম। ক্যাম্পে থাকার দুই মাসের মধ্যে নির্ঝরের নির্যাতনের শিকার হয়ে ২টি ছেলে মারা গিয়েছে। আমাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। জ্ঞান ফেরার পর আবারও মেরেছে। মারার ফলে আমার চোখের মধ্যে রক্ত জমাট বেধে গিয়েছিল।

সম্প্রতি বাংলাদেশে নিজ বাড়িতে ফিরেছে অভিযুক্ত আজিজুল হক নির্ঝর। তার কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি নিজেও কাজের সন্ধানে লিবিয়া গিয়েছিলাম। আমাকে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়ারা বন্দি করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পের বসে সবাই অনেক কান্নাকাটি আর চেচামেচি করতো। আমি আরবি জানতাম বলে শরীফ আমাকে সবাইকে চুপচাপ রাখতে দায়িত্ব দিয়েছিল।

সবাইকে নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, টাকা পয়সার ব্যাপারে আমি কিছু জানতাম না। আমি শুনেছি ওখানে সাড়ে ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়। আমি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা নেইনি। আমি শুধু সবাইকে চুপচাপ রাখার জন্য শাসন করেছি। আমি ক্যাম্পে ভালো সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য এই দায়িত্ব পালন করেছি। কেউ যদি আমার নামে অভিযোগ করে থাকে সেটা সত্য না।

এ বিষয়ে মাদারীপুর জেলা পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। মানবপাচার রোধে আমরা বদ্ধপরিকর। মানুষকে কোথাও আটকে রেখে জিম্মি করে টাকা পয়সা নেওয়া মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমরা আইনের মধ্যে থেকেই মানবপাচারকারীদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করছি, অনেককে আমরা গ্রেফতারও করেছি। আর সকল অভিভাবকদের উদ্দেশে বলা, তারা যেন অবৈধ পথে তাদের সন্তানকে বিদেশ পাঠিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দেয়।

সূত্র : ঢাকা মেইল

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...