উচ্চঝুঁকির ভূমিকম্পে রাজধানীর ৬০ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়বে

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ৬ এপ্রিল ২০২৩, ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ

তুরস্ক ও সিরিয়ায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি স্মরণকালের কয়েক দফার ভয়াবহ ভূমিকম্পে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ধসে পড়ে হাজার হাজার ভবন। দুটি দেশেই মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। এমন প্রেক্ষাপটে সাধারণভাবেই সামনে আসে বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকির বিষয়টি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা শহরে যদি উচ্চ, মাঝারি বা বড় ধরনের ভূমকম্পন হয়, তাহলে এ শহর কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে? অথবা ভূমিকম্প রোধে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

রাজধানী ঢাকাকে দেখভাল করতে সেবাখাত হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো হলো- ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এ সংস্থাগুলোর অধীনে ঢাকার অদূরের উপজেলা- সাভার ও কেরাণীগঞ্জ, পার্শবর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আংশিক এলাকার প্রায় ২৬ লাখ স্থাপনা আছে। এসব এলাকার ৬৬ শতাংশ ভবনই নিয়ম মেনে নির্মিত হয়নি। রাজউক এলাকায় ৬০ শতাংশ ও দুই সিটি কপোরেশনের মধ্যে ৩০ শতাংশ ভবনই নরম মাটির উপর অর্থাৎ জলাভূমি ভরাট করে গড়ে উঠেছে। এ অবস্থায় ঢাকার ৬৫ শতাংশ ভবন রয়েছে ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গষেণায় (এইচবিআরআই) এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ভূত্বাত্তিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে, যা মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। অথচ রাজধানীতে কতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং কতটা ভূমিকম্প সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তালিকা নেই খোদ সংস্থাগুলোর হাতে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে- বিপদ এলে কীভাবে সামাল দেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকসহ অন্যান্য সংস্থা?

ভূমিকম্পের ধকল সামলাতে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘ভূমিকম্পসহ সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী মাস থেকে মিরপুর ও মহাখালী ভবনের নির্মাণ অনুমোদন দেওয়ার সময় স্থাপত্য নকশা, কাঠামোগত নকশার পাশাপাশি মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক ও অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত নকশা জমা নেয়া হবে। আগামী মে মাস থেকে এ পদ্ধতিটি পুরো রাজউক এলাকায় চালু করা হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন হয় মূলত রাজউক থেকে। ভবনটি নিয়ম মেনে নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা বা বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে তারা সরাসরি কোনো কাজ করে না। তবে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু শহরের জনগুরুত্বপূর্ণ ভবনের ভূমিকম্প সহনশীলতা নিয়েই কাজ করা হয়ে থাকে।

এ প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ২০০ সরকারি ভবনের সমীক্ষা করা হয়েছে। প্রথম পর্বে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট ভবনগুলোর সমীক্ষা করা হয়েছে। আমরা প্রস্তাব করেছি, ৩ হাজার ২০০ ভবনের মধ্যে ২ হাজার ৮০০ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ, ফলে সেগুলো সংস্কার করতে হবে। তার মধ্যে ২৪০টি ভবন অতি ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো যত দ্রুত সম্ভব ভেঙে ফেলতে হবে। কিন্তু আবাসিক ভবন নিয়ে কোনো কাজ হয়নি।’

গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) মহাপরিচালক মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ। এ পরিপ্রেক্ষিতে কী পরিমাণ ভবন ভূমিকম্প সহনীয় কিংবা কী পরিমাণ ভবন ঝুঁকিতে রয়েছে, তা জানতে জাইকার সহায়তায় এইচবিআরআই একটি গবেষণা পরিচালনা করছে।

এরই মধ্যে ঢাকার ৮০০ বিল্ডিংয়ের ওপর জরিপ করা হয়েছে। যেসব ভবন অত্যাধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেগুলোকে ‘রেড’, তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে ‘ইয়েলো’ এবং নিরাপদ ভবনগুলোকে ‘গ্রিন’ জোনে রাখা হয়েছে। শিগগিরই গবেষণার ফলাফল সরকারের কাছে পেশ করা হবে।’

ভূমিকম্প সোসাইটির মহাসচিব ও বুয়েটের প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘বাংলাদেশও ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকা। ভেতরে ও সীমান্ত এলাকায় ৫টি ফল্ট লাইন আছে। ১৭৬২ সালে আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সাইকেল হিসেবে সেটি এখনো ফিরে আসেনি। এরপর ১৮৮৫ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা হয়তো আরো ১০-২০ বছর পর হতে পারে। এরকম ১৫০-২৫০ বছরের যে সাইকেল আছে, সেটি কখন হবে কেউ জানে না। আসলে ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করা সম্ভব নয়। তবে ব্যবস্থা একটাই, প্রস্তুতি নিতে হবে।’

প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার কাজ খুবই ব্যয়বহুল। এরপর আমাদের পর্যাপ্ত সরঞ্জামও নেই। ৮০ হাজার ভলান্টিয়ার তৈরি করার কথা থাকলেও আমার জানা মতে ২৫-৩০ হাজার তৈরি করা হয়েছে।’

বুয়েটের এই অধ্যাপক আরো বলেন, ধরেন পুরান ঢাকায় যদি ভূমিকম্প হয়, সেখানে উদ্ধারকাজের জন্য কোনো গাড়িই সহজে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু আগে থাকতেই যদি প্রস্ততি থাকে তাহলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া যাবে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় কমিউনিটিকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের অফিসে উদ্ধার সরঞ্জাম রেখে দিতে হবে। না হলে এ ইস্যুগুলো আমাদের জন্য একসময় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত, উদ্ধারকাজের জন্য নিয়মিত কিছু মহড়া করে করে প্রস্তুতি নিতে হবে। যেমনটা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়।

জানা গেছে, দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে জাতীয় পরিকল্পনা শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১৯ সালে সেটি পরিমার্জন করা হয়। এরপর ২০১০ ও ২০১৯ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকায় সব ভবনে ও কাঠামোর ঝুঁকি নিরূপণে জরিপ পরিচালনা ও তালিকা তৈরির দায়িত্ব রাজউকের। কিন্তু ১২ বছরেও সেই তালিকা হয়নি।

অপরদিকে ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রস্তুতি না থাকার অভিযোগ উঠলেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় বলছে, উদ্ধার কাজের জন্য সিটি কর্পোরেশনগুলোকে আলাদা আলাদা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এসব অঞ্চলে ৩৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরের কেন্দ্র থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে যদি সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প উৎপন্ন হয়, তাহলে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৬০৪টি ভবন মাঝারি মাত্রার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ২ লাখ ৩৮ হাজার ১৬৪টি ভবন অর্থাৎ ৭৩ শতাংশ ভবন মেরামত অযোগ্য হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...