সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি : আবহাওয়া চরমভাবাপন্নের আশঙ্কা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক,

  • প্রকাশিত: ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১:৩০ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। তাপমাত্রা অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) প্রাথমিক তথ্যে দেখা যায়, এপ্রিলের শুরুর দিক থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা রয়েছে ২১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাসের এ তাপমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে ২০১৬ সালে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ ২১ সেলসিয়াস সীমা।
নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির জলবায়ু বিজ্ঞানী অধ্যাপক ম্যাথিউ ইংল্যান্ডের বরাতে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাপমাত্রার বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এটি আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
বিস্তৃত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে তিন বছরের ‘লা নিনা’ পরিস্থিতি বৈশ্বিক তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমিয়ে দেয়ায় ভূমিকা রাখছে। লা নিনা এক ধরনের শীতল স্রোত। ফলে এ পরিস্থিতি চলাকালীন পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে স্বাভাবিকের চেয়ে শীতল সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়। এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে সৃষ্টি হওয়া উচ্চচাপ আয়ন বায়ুর পশ্চিমমুখী গতিকে ত্বরান্বিত করে। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলীয় এলাকাগুলোতে শুষ্ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। উল্টোদিকে একই স্রোতের প্রভাবে মহাসাগরের পশ্চিম দিকে নিরক্ষীয় অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটবে।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এখন সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা এ বছরের শেষদিকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে ‘এল নিনো’ পরিস্থিতি তৈরির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এল নিনো উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এর প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে প্রচুর বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। তাদের আশঙ্কা, এ পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার রেকর্ডও ভেঙে দিতে পারে বারবার।
এনওএএর বিজ্ঞানী ডা. মাইক ম্যাকফ্যাডেন বলছেন, সম্প্রতি লা নিনা পরিস্থিতি শেষ হয়ে গিয়েছে। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বৃদ্ধি সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী শীতকাল দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে এল নিনোর সময় এ অঞ্চলে সমুদ্রের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ থাকবে এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্টভাবেই পরিবেশে প্রভাব ফেলতে শুরু করবে।
গার্ডিয়ান বলছে, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং বন উজাড় করার ফলে বায়ুমণ্ডলে ক্রমাগত গ্রিনহাউস গ্যাস যুক্ত হয়ে হয়ে তাপমাত্রা বেড়েছে। আর অতিরিক্ত তাপের ৯০ শতাংশ শোষণ করে সমুদ্রের এমন দশা হয়েছে।
তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, সমুদ্রে উপরিভাগের তাপমাত্রা ক্রমেই নিচের দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ইউএস ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক রিসার্চের বিজ্ঞানী ড. কেভিন ট্রেনবার্থ বলেছেন, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরের উপরিভাগের তাপ ১০০ মিটারেরও বেশি নিচে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সমুদ্রস্রোতকে প্রভাবিত করবে এবং ভূমির আবহাওয়া পরিবর্তনে নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
ড. অ্যালেক্স সেনগুপ্তের বরাতে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ১৯৮০ সালের পর থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠে তাপমাত্রা মোটামুটি একই রেখায় ছিল। কিন্তু লা নিনা পরিস্থিতি চলার পরও গত তিন বছরে দক্ষিণ ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ আটলান্টিক, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডের চারপাশে, অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব এবং মধ্য আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক এলাকার তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। একই সঙ্গে এতগুলো এলাকার তাপমাত্রা চরমভাবাপন্ন হয়ে ওঠাকেও জলবায়ুর জন্য নেতিবাচক বলে মনে করছেন তিনি।
শুধু সমুদ্রস্রোত এবং ভূপৃষ্ঠের আবহাওয়াই নয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রভাবিত হচ্ছে সমুদ্রের পরিবেশেও। সামুদ্রিক বন্যপ্রাণীর ওপরও বিধ্বংসী প্রভাব ফেলতে পারে এ পরিস্থিতি। সমুদ্রের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে ফেলার পাশাপাশি ধ্বংস করে দিতে পারে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রবাল প্রাচীরগুলোকেও।
এ পরিস্থিতিকে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ই বলছেন বিজ্ঞানীরা। মোনাশ ইউনিভার্সিটির জলবায়ু বিজ্ঞানী প্রফেসর ডায়েটমার ডোমেনগেট বলছেন, সমুদ্রে অনেক বেশি পরিষ্কার হয়ে দেখা দিচ্ছে মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতার সংকেত। শিগগিরই আমরা একটি চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। আমাদের গবেষণা অচিরেই একটি এল নিনো অবস্থার পূর্বাভাস দিচ্ছে। এমনটা ঘটলে আমরা শুধু সমুদ্রেই নয়, এ বছরের শেষদিকে ভূমিতেও তাপমাত্রার নতুন নতুন রেকর্ড দেখতে পাব।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...