হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মাওলানা ওমর ফারুক,

  • প্রকাশিত: ২৯ মে ২০২৩, ৭:৩৬ অপরাহ্ণ

প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু স্বপ্ন থাকে। একজন ঈমানদারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্নগুলোর অন্যতম হলো বাইতুল্লাহর জিয়ারত। যে বাইতুল্লাহকে কিবলা ( কেন্দ্র ) বানিয়ে প্রতিদিন সালাত আদায় করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা, যে বাইতুল্লাহকে আল্লাহপাক মানবজাতির ঐক্য ও নিরাপত্তার কেন্দ্র বানিয়েছেন, সে বাইতুল্লাহ এবং আল্লাহ প্রেমের স্মৃতি বিজড়িত মিনা, মুজদালিফা, আরাফা, সাফা-মারওয়াকে দুই চোখে দেখা, আল্লাহ প্রেমিকদের তালিকায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে অতীত ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করিয়ে নেয়ার বাসনা প্রত্যেক মুমিনের অন্তরেই চির জাগ্রত থাকে। হজের মাধ্যমে হাজী সাহেবগণ আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হিসেবে গুনাহ মুক্ত জীবন গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ফিরে আসেন। হজ যেন এক জীবন্ত বিপ্লব।

হজের আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা। পরিভাষায়, মিকাত থেকে বাইতুল্লাহ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে নির্দিষ্ট দিনে বাইতুল্লাহ, মিনা, আরাফাহ, মুজদালিফা ও সাফা মারওয়ায় শরিয়া নির্দেশিত কার্যাবলী সম্পাদন করাকে হজ বলে। নবীজি (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ করবে, কোন অশ্লীলতা বা গুনাহের কাজে লিপ্ত হবেনা, সে সদ্যপ্রসূত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।” (সহীহুল বুখারী: ১৫২১)। নবীজি (সাঃ) আরো বলেন, “কবুল হজের বিনিময় জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়”। (সহীহুল বুখারী: ১৭৭৩)।

হজের সফরের রওনা হওয়ার পূর্বে যাবতীয় দৈহিক এবং আত্মিক অপবিত্রতা থেকে ব্যক্তি নিজেকে পবিত্র করে নেওয়া আবশ্যক। অজু গোসল তায়াম্মুমের মাধ্যমে যেমন বাহ্যিক পবিত্রতা অর্জিত হয়, তেমনি শিরক, কুফর, নিফাকের অপবিত্রতা থেকে নিজেকে মুক্ত করা ব্যতীত কারোর হজ গ্রহণযোগ্য হয় না। হজের সফরে যাবতীয় হারামের স্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা আবশ্যক। তা যেমন হারাম খাদ্য-পানীয়ের ক্ষেত্রে, তেমনি হজের সফর সম্পন্ন করে ফিরে আসা পর্যন্ত কোন হারাম উপার্জন যেন তাতে মিশ্রিত না হয়, সে বিষয়ে সর্বশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা। অবশ্য একজন ঈমানদারকে সারা জীবনেই হারামের ছোঁয়া মুক্ত থাকা আবশ্যক। কারো সম্পদ বা সম্মানহানি করে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ থেকে দায়মুক্ত হয়ে নেওয়া জরুরি।

সামর্থ্যবান মুসলিমদের ওপর জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ। একের অধিক হজ নফল বিবেচিত হয়ে থাকে (আলে ইমরান: ৯৭, আবু দাউদ: ১৭২১)। কোন ব্যক্তি যে বছর হজের সামর্থ্য লাভ করেন, সে বছরেই তাঁর ওপর হজ আবশ্যক। তবে ছুটে না যাওয়ার শর্তে তা বিলম্বে আদায় করা জায়েজ (আবু দাউদ: ১৭৩২)। ব্যস্ততা বা উদাসীনতার কারণে কেউ দরিদ্র বা অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাঁর হজের ফরজ রহিত হয় না। পবিত্র বাইতুল্লাহ এবং হজের আনুষ্ঠানিকতার সাথে সম্পৃক্ত স্থান সমূহে যাতায়াত, সেগুলোতে অবস্থানকালীন ব্যয় এবং হজ সম্পন্ন করে ফিরে আসা পর্যন্ত নিজ পরিবার-পরিজনের আবশ্যকীয় ব্যয়ভার বহনে সক্ষম প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, শারীরিক মানসিকভাবে সুস্থ-সক্ষম স্বাধীন মুসলিমের ওপর হজ ফরজ। উল্লেখ্য, যে ভূমি বা দালানের উপার্জনের উপর ব্যক্তি নির্ভরশীল নয়, তার মূল্য হজের নেসাবের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকে।

হজ তিন প্রকার- ইফরাদ হজ: মিকাত হতে শুধু হজের জন্য ইহরাম বাঁধা। কিরান হজ: মিকাত হতে একই সাথে ওমরা ও হজের জন্য ইহরাম বাঁধা। তামাত্তু হজ: মিকাত হতে শুধু ওমরার জন্য ইহরাম বাঁধা। ওমরা পালন শেষে হালাল হয়ে মক্কায় অবস্থান করা এবং যিলহজের ৮ তারিখে হারামের সীমানা থেকে হজের জন্য ইহরাম বেঁধে হজ সম্পন্ন করা। উল্লেখ্য, ওমরা থেকে হালাল হওয়ার পর হজের ইহরাম বাঁধার পূর্বে তামাত্তু হাজীগণের বারবার ওমরা করার বিষয়টি কুরআন-সুন্নাহ এবং সালাফে সালেহীনের আমল থেকে প্রমাণিত নয় বিধায় তা থেকে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য। বরং অধিক পরিমাণে নফল তাওয়াফ করাই সুন্নাহ সম্মত।

হজের ফরজ তিনটি- ইহরাম, আরাফার ময়দানে অবস্থান, তাওয়াফ। হজের ওয়াজিব ছয়টি- মুজদালিফায় অবস্থান, জামারাতে কংকর নিক্ষেপ, দমে শোকর বা কুরবানী করা (কিরান এবং তামাত্তু হাজীদের জন্য), মাথা মুন্ডানো অথবা চুল ছোট করা, সাফা-মারওয়ায় সাঈ করা, বিদায়ি তাওয়াফ ( মিকাতের বাইরে থেকে আগতদের জন্য)। হজের সুন্নাতসমূহ; ইহরামের পূর্বে গোসল করা, পুরুষদের ইহরামের চাদর সাদা হওয়া, অধিক পরিমাণে তালবিয়া পাঠ করা, ইফরাদ হাজীগণ তাওয়াফে কুদুম করা, ৮ যিলহজ যোহর থেকে ৯ যিলহজ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা, ৮, ১০ ও ১১ যিলহজ দিবাগত রাতে মিনায় অবস্থান করা, ৯ যিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া, উকূফে আরাফার উদ্দেশ্যে গোসল করা, ৯ যিলহজ দিবাগত রাতে সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত মুযদালিফায় অবস্থান করা, ১১ ও ১২ যিলহজ ছোট ও মধ্য জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর দোয়া করা, তাওয়াফের শুরুতে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ ও চুম্বন করা, অপারগতায় ইশারা করা, যে তাওয়াফের পর সাঈ আছে সে তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে পুরুষগণ রমল ও পূর্ণ সাত চক্করে ইজতেবা করা।

আরবি ইহরাম শব্দের অর্থ নিষিদ্ধ করে নেওয়া। হজ বা ওমরা যাত্রীগণ মিকাতে পৌঁছে হজ বা ওমরার উদ্দেশ্যে নিয়তের সাথে তালবিয়া পাঠ করাকে ইহরাম করা বা ইহরাম বাঁধা বলা হয়। উল্লেখ্য, অন্তরের দৃঢ় ইচ্ছা বা সংকল্পই হলো নিয়ত। তবে হজ বা ওমরার নিয়ত অন্তরের সংকল্পের সাথে মুখে উচ্চারণ করা উত্তম। ইহরামের বিধান: হজ এবং ওমরার জন্য ইহরাম বাঁধা ফরজ। ইহরাম ব্যতীত মিকাত অতিক্রম করলে পুনরায় মিকাতে ফিরে আসা আবশ্যক। নতুবা দম ওয়াজিব হবে। হাজীদের ওমরা থেকে হালাল হওয়ার পর হারামের সীমানায় অবস্থান করতে হয়। যে কোন উদ্দেশ্যেই মিকাতের বাইরে যাওয়া সুন্নাহ পরিপন্থী। তবে মিকাত অতিক্রম করে মদিনা, তায়েফ বা অন্য কোন দূরের জায়গায় সফর করলে পুনরায় মিকাত থেকে ইহরাম করতে হবে কিনা এ মাসয়ালায় আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আবু হানিফার মতে নতুন করে ইহরাম করতে হবেনা। তবে তাঁর দুই ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতে নতুন করে ইহরাম করতে হবে। যে সকল হজযাত্রী মদিনা মুনাওয়ারা জিয়ারত করতে ইচ্ছুক, তাঁদের উচিত ইহরামের পূর্বেই মদিনা জিয়ারত সম্পন্ন করা অথবা হজ সম্পন্ন হওয়ার পরে মদিনায় গমন করা। ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়গুলি প্রতিপালনে সচেষ্ট থাকতে হবে। নচেৎ হজ বা ওমরা আদায়কারীর উপর দম, বাদানা বা সদকা ওয়াজিব হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

তালবিয়া: আরবি তালবিয়া শব্দের অর্থ আহবানে সাড়া দেওয়া। শরীয়তের পরিভাষায় হজ বা ওমরা আদায়কারী নিম্নোক্ত বাক্য উচ্চারণ করাকে তালবিয়া বলে- “লাব্বাইকাল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা- শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা- শারীকা লাক। তালবিয়ার অর্থ: “আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির। আপনার আহবানে সাড়া দিয়ে আমি হাজির, আপনার কোন শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, নিয়ামত এবং রাজত্ব শুধু আপনারই, আপনি অংশীদার মুক্ত”।

তালবিয়ার বিধান: এহরাম বাঁধার‌ সময় নিয়তের সাথে একবার তালবিয়া উচ্চারণ করা ফরজ। পুরুষদের উচ্চস্বরে ও মহিলাদের নিম্নসরের তাল্বিয়া পাঠ করতে হয়, মনে মনে পাঠ করলে তালবিয়া আদায় হবে না। প্রত্যেক স্থান পরিবর্তনে অধিক পরিমাণে তালবিয়া পাঠ করা মুস্তাহাব। হাদীস শরীফে এসেছে, “উত্তম হজ হলো তা, যাতে অধিক পরিমাণে তালবিয়া পাঠ করা হয় এবং উৎকৃষ্ট মানের পশু কুরবানী করা হয়” (তিরমিযি: ৮২৭, সহীহ।) ওমরার তালবিয়া বাইতুল্লায় পৌঁছে তাওয়াফের পূর্বে এবং হজের তালবিয়া ১০ যিলহজ বড় জামরায় পৌঁছে কংকর নিক্ষেপের পূর্বে বন্ধ করতে হয়।

মিকাত: বাংলাদেশ থেকে জেদ্দা হয়ে হজ বা ওমরা গমনকারীদের মিকাত: স্থলপথের মিকাত- ইয়ালামলাম। জল পথের মিকাত- জেদ্দা সমুদ্র বন্দর। আকাশ পথের মিকাত- বাংলাদেশ থেকে জেদ্দা গমন কারী বিমান সাধারণত ‘কারনুল মানাযিল’ অথবা ‘যাতু ইরক’ নামক মিকাত অতিক্রম করে থাকে বিধায় মিকাতদ্বয় বরাবর আকাশ অতিক্রমের পূর্বেই ইহরাম সম্পন্ন করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে মদিনা হয়ে হজ বা ওমরা গমনকারীদের মিকাত: যে সকল হজ বা ওমরা আদায়কারী প্রথমে মদিনায় গমন করে থাকেন, তাঁদেরকে বিমানে ইহরাম বাঁধতে হয় না। শুধু মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হলে মদিনার মিকাত ‘যুল হুলাইফা’য় এসে তাঁদের ইহরাম বাঁধতে হয়।

হজ ইসলামের চতূর্থ স্তম্ভ (সহীহুল বুখারী: ০৮)। হজের বিনিময়ে অতীতের সব গুনাহ মুক্তির ঘোষণা এসেছে (সহীহুল বুখারী: ১৫২১)। হজ আল্লাহ প্রেমিকদের মিলন মেলা (তিরমিযি: ২৯৯৮) হজের মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহ পাকের পছন্দকে নিজের পছন্দের উপর প্রাধান্য দেওয়া এবং আল্লাহর বিধানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার স্বীকৃতিই প্রদান করে থাকেন। হজের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সময়, সম্পদ, ব্যক্তিত্ব কুরবানির বাস্তব প্রশিক্ষণ অর্জিত হয়ে থাকে। হজ আমিত্ব বিবর্জিত ও গুনাহ মুক্ত জীবন গড়ার প্রশিক্ষণ। হজ মানুষকে বিনয়, শৃঙ্খলা, ঐক্য, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা শেখায়।

আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে হাজ্জে মাবরুর নসিব করুন, আমীন।

লেখক: ইমাম ও খতীব বাংলাদেশ সচিবালয় জামে মসজিদ

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...