সব
মজিবুল হক মনি,
প্রায় অর্ধশতকেরও অধিক সময় পূর্বে বাংগালী বিলেতের মাটিতে অভিবাস জীবনের সূচনা ঘটায়। বাংগালী কমিউনিটি শিক্ষা, মূলধারায় পেশা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধশীল কমিউনিটিতে পরিনত হতে থাকে। আজ এই কমিউনিটি বৃটেনের মূল ধারার প্রতিটি সেক্টরে সাফল্যের ছাপ রাখতে সমর্থ হয়েছে। তবে এই সাফল্যের যাত্রা যে খুবই নিরাপদ, নিষ্কংকট ছিল তা বলার কোন সুযোগ নেই। এই সাফল্য যাদের হাত ধরে পূর্নতা পেয়েছে আমরা তাদের কমিউনিটি চ্যাম্পিয়ান বলে আখ্যায়িত করি।
আজ আমি এমনি এক সফল ও জনপ্রিয় কমিউনিটি চ্যাম্পিয়ন দম্পতির গল্প আপনাদের সংগে শেয়ার করবো।
লেখার শুরুতে এই নন্দিত দম্পতির সংগে আমার সংযোগের গল্পটি বলছি। ১৯৯৩ইংর জানুয়ারী মাসে আমি বিলাতে আসি। আমার বয়স তখন ত্রিশের কোটায়। দেশে থাকাকালীন সময়ে সেই প্রাথমিক শিক্ষাজীবন থেকে পেশাজীবন অবদি সাহিত্য সংস্কৃতির সংগে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রেখেছিলাম। কর্মমূখর বিলাতের যান্ত্রিক জীবনও সাহিত্য সংস্কৃতির অংগন থেকে আমাকে দূরে রাখতে পারেনি। ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান বানে’ প্রবাদটি আমার মতো সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মিদের ক্ষেত্রে অধিক প্রযোজ্য। আর এরই সূত্রধরে পূর্বলন্ডনের ব্রিকলেইন সংলগ্ন ঐতিহাসিক টয়েনবী হলে এশিয়ান ষ্টাডিজ ডেভেলপমেন্টের দুই কর্মকর্তা রহমান জিলানী এবং এমদাদ তালুকদারের সংগে আমার পরিচয় হয়। সে সময়ে টয়েনবী হল বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা ও প্রদর্শনের কেন্দ্র হিসাবে সমোধিক পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের বাইরে এই টয়েনবী হলে প্রথমবারের মতো ১৯৯৬ইং এবং পরবর্তিতে -১৯৯৮ইং ও ২০০০ইং সালে বিলাতের মাটিতে বাংলা নাট্য উৎসব রহমান জিলানী ও এমদাদ তালুকদারের তত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়। এই আয়োজনে আমিও কিছুটা সম্পৃক্ত ছিলাম আর এরই সুবাদে এমদাদ তালুকদার এবং তাঁর জীবনসংগীনি মাহফুজা রহমানের সংগে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। আমার গল্পের নায়ক নায়িকা এমদাদ তালুকদার ও মাহফুজা রহমান।
এমদাদ তালুকদার ও মাহফুজা রহমান দম্পতি বিলাতে স্থায়ীভাবে ১৯৮৯ইং সনে বসবাস শুরু করেন। অত্যন্ত অমায়িক, সৎসাহসী, কর্মোদ্যম, সৃজনশীল, জনপ্রিয় এই কর্মকুশল দম্পতি তাঁদের নিয়মিত পেশাবৃত্তির পাশাপাশি বাংগালী কমিউনিটিতে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা হিসাবে নিজেদের নিয়জিত রেখে আসছেন। এমদাদ তালুকদার বিলাতে সাহিত্যামোদিদের হৃদস্পন্দন অধুনালুপ্ত বাংলা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি পদে কয়েক মেয়াদ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। মাহফুজা রহমান একাধারে কবি, সাহিত্যিক, টিভি মডেল, নাট্টকর্মি, অসংখ্য মঞ্চনাটক, টিভি নাটক এবং টেলিফিল্মের একজন অনবদ্য অভিনেত্রী হিসাবে সর্বজন প্রশংসিত।
এমদাদ তালুকদার পরিবার পরিজন নিয়ে একদা বাস করতেন বাংগালীর রাজধানীখ্যাত বাংলা টাউন ব্রীকলেইনে। তাঁদের এই বাসাটি তখন কবি সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নে্তাকর্মীদের এক নিয়মিত আড্ডাখানায় পরিনত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে স্থানীয় কবি নজরুল সেন্টারে সংগীত, নৃত্য, নাটকের অভিনয় ইত্যাদির রিহার্সেলের নিয়মিত চর্চা হতো। বর্ত্তমানে এমদাদ তালুকদার ও মাহফুজা রহমান পশ্চিম লন্ডনের অভিজাত এলাকা কেন্সিংটনে বাস করছেন। নব্বই দশকের সেই আনন্দময় জমজমাট দিনগুলো এখনও স্মৃতিপটে আলোকোজ্জ্বল। এমদাদ তালুকদার বাংলাদেশে বৃহত্তর বরিশাল জেলার মানুষ দেশে যিনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন এবং মাহফুজা রহমান ঢাকার অনতিদূরে গাজীপুরে জন্মগ্রহন করেন। দেশে থাকতে তিনি গাজীপুর কলেজের একজন প্রভাষক ছিলেন।
এবার শতগুণে গুণান্বিত এই দম্পতির পেশাগত পরিচয় কি তা জেনে নেই।। এমদাদ তালুকদার টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ফস্টারিং সেকশনের একজন অত্যন্ত দক্ষ কর্মকর্তা হিসাবে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করে আসছেন যার মাধ্যমে কমিউনিটিতে ফস্টারিং সার্ভিসের প্রতি আগ্রহ সৃষ্ট ও এটির গুরুত্ব ও সুবিধা সম্পর্কে উৎসাহ প্রদান করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি স্থানীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, চার্চ, জিপি সার্জারী, স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টার এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা নেন। আমরা ইতমধ্যেই জেনেছি যে, তাঁর এই মানবিক ও মহতি কাজ ফস্টারিং সার্ভিসে অভূতপূর্ব সফলতার স্বীকৃতিসরূপ তিনি বৃটেনের মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছ থেকে এম বি ই (মেম্বার অফ দা অর্ডার অফ দা বৃটিশ এ্যাম্পায়ার) খেতাব লাভ করেছেন যা বিলাতে প্রবাসী বাংগালী কমিউনিটির জন্য একটি গৌরবময় অর্জন।
বিলাতের এত ব্যস্তময় জীবনের মাঝেও এই নিবেদিত প্রান এমদাদ তালুকদার ও মাহফুজা রহমান দম্পতি একমাত্র কন্যা সন্তান একুশ ছাড়াও একটি অসহায় এতিম প্রতিবন্ধী বাচ্চা ছেলেকে লালন পালন করতেন। সেই বাচ্চাটি এখন যুবক, আই টিতে গ্রেজুয়েশন করেছে, তাকে বাংলাদেশে নিয়ে একটি লক্ষী মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে এখন সবাই মিলেমিশে একসংগে বসবাস করছেন।
এতগুলো জটিল ও কঠিন দায়িত্বগুলো পালনের পাশাপাশি এই দম্পতি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসারে এতটুকু পিছপা হননি। নাটক সহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় দেড়যুগ আগে সিলেটি পরিভাষায় নির্মিত, প্রখ্যাত নাট্টকার নূরুল আমিন পরিচালিত ‘হায়রে লন্ডন শান্তি নাই’ টেলিফিল্মে একজন দুঃখী স্ত্রী ও অসহায় মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে বৃটেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংগালীর কাছে ভূঁয়ুসী প্রশংসা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন। এই মাহফুজা রহমানই সর্বপ্রথম বিলাতে জন্ম নেয়া ও বেড়ে উঠা ৫০টি বাংগালী ছেলেমেয়েকে নিয়মিত প্রশিক্ষন দিয়ে বাংলা মঞ্চ নাটকে অভিনয় ও নৃত্যশিল্পে সমর্থ করে আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকে এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের সংগে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সেই ছেলেমেয়েরাই এখন বড় হয়ে তাদের জাতিগত সত্ত্বাকে বুকে নিয়ে এদেশের মূলধারার বিভিন্ন পেশায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একবার মাহফুজা রহমান ‘ফিরিয়ে দাও কুমারিত্ব’ নামে একটি একক অভিনিত নাটকে অভিনয় করে এদেশের সুধী সমাজে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি একজন প্রথিতযশা গীতিকারও বটে। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন প্রথম শ্রেনীর গীতিকার। তাঁর গানে সুর করেছেন প্রণব ঘোষ, আহম্মদ ইমতিয়াজ বুলবুল প্রমূখ। এ ছাড়াও তিনি নিয়মিত নাটক লিখেন, কবিতা ও গল্প লিখেন।
এবার আসি মানবিক গুনাবলীর দিক থেকে আমি এই দম্পতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করতে পারি। শতভাগ নম্র, ভদ্র, অমায়িক, নির্ভেজাল, সৎ, উদ্যমী, সৃজনশীল, দম্পতি হিসাবে তাঁদেরকে আখ্যায়িত করতে চাই। আজ প্রায় ত্রিশ বছরের অধিক সময়ে ধরে এই দম্পতির সংগে আমার পরিচয়। কমিউনিটিতে অনেক চারাই উতরাই সংঘটিত হয়েছে, অনেকেই সফলতার উচ্চশিখরে স্থান করেছেন আবার অনেকেই সময়ের আবর্তে ঝরে পড়েছেন কিংবা আড়াল হয়েছেন কিন্তু এই দম্পতি কোথাও কারো প্রতি কোন উচ্চবাচ্য, অহেতুক তর্ক বিতর্ক, প্রতিহিংসাপরায়ন¸পরশ্রীকাতরতার মতো চারিত্রিক ব্যাধি তাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি। একটি সুশীল কমিউনিটির জন্য এই আলোকিত দম্পতি একটি উজ্জ্বল উদাহরন হয়ে থাকবে।
অতিসম্প্রতি এই জননন্দিত দম্পতি এমদাদ তালুকদার ও মাহফুজা রহমান দুজনে একসংগে বৃটেনের অত্যন্ত উচ্চমানের সম্মাননা “ফ্রিডম অব লন্ডন” সনদ লাভ করেন যা শুধু এই দম্পতির জন্যেই নয় বরং সমগ্র বাংগালী কমিউনিটির জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। সিটি অব লন্ডন বিগত ১২৩৭ইং সাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে গুনিজনদেরকে এই সম্মাননা দিয়ে আসছে। এই সম্মাননা লাভের তালিকায় আছেন রানী ১ম এলিজাবেথ, রানী ২য় এলিজাবেথ, বর্তমান রাজা চার্লস, স্যার এটলী, নেলসন ম্যান্ডেলাসহ আরোও অনেকে। আমরা এই আলোকিত দম্পতির জন্যে গর্বিত।
পরিশেষে,
এনে দিয়েছো এই জনপদে অনিন্দ কর্মের গৌরব,
ছড়িয়ে দিয়েছো সবার মাঝে তব কীর্তির সৌরভ!
আসুন, আমরা সবাই এই দম্পতিকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই এবং স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি যেন দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য নিয়ে তাঁরা তাঁদের এমনি মহতী কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন।
Developed by: Helpline : +88 01712 88 65 03