শ্রমিক কনভেনশনে বিএনপির ৩২ প্রস্তাবনা

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯:২৭ অপরাহ্ণ

দ্রব্যমূল্য, মজুরি কমিশন, জাতীয় বেতন স্কেল, নূন্যতম মজুরি, শ্রম পরিস্থিতি এবং চলমান এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল ও সম্মিলিত শ্রমিক পরিষদ আয়োজিত জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী কনভেনশনে ৩২টি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।

শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে অনুষ্ঠিত এই কনভেনশনের সমন্বয়ক ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস লিখিত বক্তব্যে এসব প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।

প্রস্তাবনা হলো–

১. আজকের শ্রমিক কনভেনশনের লক্ষ্য সব ধরনের শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাদের বেতন-ভাতা, ছুটিসহ অন্যান্য মৌলিক দাবি পূরণ করা। শ্রমিকদের সামগ্রিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

২. শ্রমআইন সংশোধন ও যুগোপযোগী করা। অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিল, শ্রম আইন ২০১৮ আগামীতে বাতিল করা হবে। ভবিষ্যতে শ্রমিকদের মতামতের প্রাধান্য থাকবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে থাকবে শ্রমিকদের অংশীদারত্ব।

৩. ভবিষ্যতে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মালিক-শ্রমিক এবং সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হবে, গঠন করা হবে বিশেষ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল।

৪. শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বিমা নিশ্চিত করা হবে। সে জন্য তৈরি করা হবে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, সড়ক পরিবহন অথবা সেন্ট্রাল ফান্ডকেন্দ্রিক একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো।

৫. শ্রমজীবী অন্তঃসত্ত্বা নারী, অসুস্থ শ্রমিক, দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক এবং বেকার শ্রমিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হবে। মাতৃত্বকালীন সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা হবে।

৬. প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য আলাদা রেজিস্ট্রেশন কার্ড দেয়া হবে, নিশ্চিত করা হবে আলাদা আইডি কার্ড। এটা তাদের হেলথ ও রেশন কার্ড হিসেবে কাজ করবে।

৭. অপ্রচলিত খাতের শ্রমিকদের প্রচলিত খাতের শ্রমিকদের মতো আনুপাতিক হারে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে।

৮. অসংগঠিত, অনিবন্ধিত শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগঠিত এবং চিহ্নিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে। শ্রমদফতর থেকে দেয়া হবে রেজিস্ট্রেশন ও আইডি কার্ড। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী তাদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।

৯. প্রত্যেক রেজিস্টার্ড শ্রমিকের কাজের ব্যবস্থা করা হবে। কাজের সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত ন্যূনতম হারে হলেও শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে সম্মানজনক ভাতা দেয়া হবে।

১০. ডিউটিরত অবস্থায় কোনও শ্রমিক মারা গেলে তার পরিবারকে আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন ভাতা দেয়া হবে। পরিবারে কর্মক্ষম কেউ থাকলে তাকে ওই স্থানে কাজের সুযোগ দেয়া হবে।

১১. শ্রমিকদের মধ্য থেকে, শ্রমিকদের মতামতের ভিত্তিতে, খাত ও ধরনভিত্তিক শ্রমিক প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।

১২. সভা-সেমিনারসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে শ্রমিকদের সচেতন করে তোলা হবে।

১৩. শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক ইস্যুতে শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েকে বিশেষ অধিকার দেয়া হবে কিংবা এ সংক্রান্ত ভাতা দেয়া হবে। দরকার হলে বাস্তবতা বিবেচনা করে সরকার তাদের দায়িত্ব নেবে।

১৪. চা শ্রমিক থেকে শুরু করে হোটেল, দোকান, নিরাপত্তাকর্মী, গৃহকর্মী, হকার, কুলি-মজুর কিংবা এ ধরনের সব শ্রমিকের জীবনধারণের উপযোগী মজুরি নিশ্চিত করা হবে।

১৫. শ্রমিকদের ওপর হয়রানি, নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করা হবে এবং নিত্য পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের চাঁদা আদায়ের সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে এবং বন্ধ করা হবে।

১৬. আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সর্বক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হবে।

১৭. ইউএন/আইএলও কিংবা অন্যান্য শ্রমিক অধিকার সংশ্লিষ্ট কনভেনশনে অংশগ্রহণকারী দেশ হিসেবে তাদের নির্দেশনা মেনে চলা হবে।

১৮. দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে শ্রমিকদের জন্য মহার্ঘ্য ভাতা দেয়া হবে। বাজার ব্যবস্থার ওপর সরকারি তদারকি জোরদার করা হবে।

১৯. শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী পে-কমিশন/মজুরি কমিশন গঠন করা হবে।

২০. বন্ধ সব শিল্প কল-কারখানা চালুর উদ্যোগ নেয়া হবে।

২১. খাতভিত্তিক শ্রমিকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে, সৃষ্টি করা হবে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র।

২২. সরকারি নীতিমালা, বাজেট প্রণয়ন কিংবা এ ধরনের কার্যক্রমে শ্রমিক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।

২৩. বাংলাদেশে প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী প্রবাসী শ্রমিকরা নানা ধরনের হয়রানি-নির্যাতনের শিকার। এসব হয়রানি-নির্যাতন বন্ধ করে তাদের কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ও কল্যাণ তহবিলকে সহজলভ্য করা হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী যোদ্ধা হিসেবে সম্মানসূচক স্বীকৃতি দেয়া হবে।

২৪. শ্রমিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, নির্যাতিত-নিপীড়িত শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে এবং যৌক্তিক ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করা হবে।

২৫. কৃষি ও শিক্ষা খাতে উন্নয়ন ঘটিয়ে কর্মক্ষেত্রের প্রসার ঘটানো হবে। সেসব ক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী শ্রমিকদের কাজ দেয়া হবে।

২৬. শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ আর কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। বাস্তবতা বিবেচনা করে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও পরিধি বাড়ানো হবে।

২৭. প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিমারি কিংবা করোনার মতো মহামারিকালে শ্রমিকদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্লাইমেট উদ্বাস্তু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া নদীভাঙা মানুষদের জেগে ওঠা চরাঞ্চল বরাদ্দ দিয়ে পুনর্বাসন করা হবে।

২৮. ইনফরমাল বা অপ্রচলিত খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের জীবনমান সম্পূর্ণভাবে মালিকদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। অনেক ক্ষেত্রে মালিকরা আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না। ভবিষ্যতে সম্মিলিত শ্রমিক পরিষদ ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদল এ অবস্থার পরিবর্তনে কার্যকর উদ্যোগ নেবে।

২৯. জিডিপির পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নারী শ্রমিকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গৃহস্থালি, পরিচারিকা, গার্মেন্টস, কৃষি খাত, চাতাল, নির্মাণ খাত, হাঁস-মুরগি প্রতিপালনসহ ৫৮ শতাংশ খাতে নারীরা নানাভাবে অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মজুরি প্রাপ্তি বা অন্যান্য সুরক্ষা প্রাপ্তিতে নারীরা চরমভাবে বঞ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতি নির্ধারণে নারীকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নারীর শ্রম, মেধা ও কষ্টসহিষ্ণুতাকে যৌক্তিক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করা হবে। নারী শ্রমিকদের জন্য আলাদা ডেটাবেজ থাকবে।

৩০. রাষ্ট্রীয়ভাবে শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের জন্য আলাদা একটা ডেটাবেজ তৈরি করা হবে। ডেটাবেজ অনুযায়ী, ভবিষ্যতে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে যে কোনও আপদ-বিপদে সহায়তা করা হবে।

৩১. প্রতি বছর গড়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ৩০ লাখ নতুন শ্রমিক। কিন্তু আনুপাতিক হারে বাড়ছে না তাদের কর্মক্ষেত্র। এই শ্রমিক আধিক্যের কারণে কম মূল্যে তাদের লুফে নিচ্ছেন মালিকরা, ফলে কমে যাচ্ছে শ্রমের মূল্য। ভবিষ্যতে সম্মিলিত শ্রমিক পরিষদ ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নেতৃত্বে শ্রমের যথাযথ মূল্য নিশ্চিত করা হবে।

৩২. শ্রমিক বাঁচলেই শিল্প বাঁচবে, কৃষি বাঁচবে। গতিশীল হবে দেশের অর্থনীতির চাকা। যার মধ্য দিয়ে বাঁচবে দেশ ও জনগণ। আজকের শ্রমিক কনভেনশনের অঙ্গিকার– চলমান এক দফার আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি শেষে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে শ্রমিক কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণ করে মেহনতি মানুষের ভালোভাবে বাঁচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।

 

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...