বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে দুই শতাধিক আহত, নিহত পুলিশ

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ


রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির ডাকা সমাবেশকে ঘিরে শনিবার দিনভর সংঘর্ষ, বোমাবাজি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এক পুলিশ নিহত ও দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষে কাকরাইল-বিজয়নগর-পল্টন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

কাকরাইল তাবলীগ মসজিদ মোড়ে পুলিশের ওপর বিএনপির নেতা-কর্মীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে কাকরাইল মোড় হয়ে নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সড়কে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে বিজয়নগর কালভার্ট রোড থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এসময় নেতা-কর্মীরা এই এলাকার বিভিন্ন বিভিন্ন গলিতে অবস্থান নিয়ে মাঝে মধ্যেই পুলিশের ওপর হামলা চালায়।

বিএনপির নেতা-কর্মীরা কমপক্ষে পাঁচ বাস, দুটি অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশের তিনটি গাড়ি, দুটি পিকআপ ও ২০টিরও বেশি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেয়। সংঘর্ষে নিহত পুলিশ সদস্যের নাম আমীরুল পারভেজ (৩৩)। সংঘর্ষের সময় বিজয়নগরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাকে বেধড়ক পেটায়।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের হামলায় আহত হয়েছেন আরো ৪১ পুলিশ সদস্য ও ১৩ সাংবাদিক।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ার শেল, জল কামান, সাউন্ড গ্রেনেড ও ছড়রা গুলি ব্যবহার করে পুলিশ। হামলাকারীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট ভবনের পার্কিংয়ে রাখা দুইটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। শান্তিনগর মোড়ে একটি বাস ও পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে একটি অ্যাম্বুলেন্সসহ দুইটি গাড়ি জ্বালিয়ে দেয় নেতা-কর্মীরা। মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে একটি বাসে আগুন দেয়। বি‌ভিন্নস্থা‌নে ১টা থেকে এ সংঘর্ষ বিকাল সাড়ে ৪ টা পর্যন্ত চলে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিভিন্নস্থানে পুলিশের ওপর হামলা এবং পুলিশকে ধরে ধরে বেধড়ক পিটাতে দেখা গেছে। এতে বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

এছাড়া বিকালের দিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের প্রায় ২০ জন নেতা-কর্মী আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশস্থল হলেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ফকিরাপুল, কাকরাইল, হেয়ার রোড, সেগুনবাগিচা, বিজয়নগর, পুরনো পল্টন, মালিবাগ ও মৌচাক এলাকায়। দুপুর থেকেই পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হলে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে এসব এলাকায়। অলিগলিতেও ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। পুলিশের উপর লাঠিশোটা ও ইটপাটকেল দিয়ে হামলা চালানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের ছোঁড়া মুহুর্মুহ টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। মালিবাগে পুলিশের এসবি কার্যালয়ের সামনে ফ্লাইওভারের নিচে রাখা পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এসময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়।

এ‌দি‌কে সমাবেশস্থল ছেড়ে পল্টন-বিজয়নগর সড়ক ও সেগুনবাগিচার অলিগলি দখলে নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের। এসময় সড়কের বেশ কয়েকটি জায়গায় কাঠ ও টায়ার জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এমনকি একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গেও সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা। বিকেলের দিকে শুরু হওয়া বিএনপি-আওয়ামী লীগ-পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে শুরু হয় রাজপথ দখলের লড়াই। এতে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। যদিও সন্ধ্যার আগে থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কমতে থাকলে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করে।

বিজিবি মোতায়েন

সন্ধ্যার পর রাজধানীতে ১১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। এদের মধ্যে রমনা, মতিঝিল ও পল্টনে পাঁচ প্লাটুন বিজিবি টহল দিচ্ছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে চার প্লাটুন ও সচিবালয়ে দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

কনস্টেবল নিহত, আহত ৪১ পুলিশ

রাজধানীতে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশের ত্রিমুখী সংর্ঘষে ৪১ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ২২ জনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আহত অবস্থায় আসাদুজ্জামান (৩৫), আব্দুস সামাদ (৩৫), মো. শাহীন(৩৪) সহ ১৯ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ব‌লে ডি্এম‌পির মিডিয়া সেন্টা‌রের ডি‌সি ফারুক হোসেন।

সংঘ‌র্ষের ঘটনায় আহত পুলিশের কনস্টেবল আমীরুল পারভেজকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বিকাল ৫টার দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত পারভেজের বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে। তিনি ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটে কর্মরত ছিলেন।

শনিবার সন্ধ্যার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রাজারবাগ পুলিশ কেন্দ্রীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ছাত্রদল নেতা পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তার ভিডিও ফুটেজ আমাদের কাছে আছে।

আহতদের তালিকা

ঢাকা মে‌ডি‌কে‌ল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সংঘর্ষের ঘটনায় ১৩০ জন চি‌কিৎসা নি‌তে আসেন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন হাসপাতা‌লে ভ‌র্তি। একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার অস্ত্রোপচার করা হ‌বে।

পুলিশ সাংবাদিকসহ সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে ৪০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে জামায়াত কর্মী নোয়াব আলী (৬০), আবু জাফর (৩৫), ছাত্রলীগ উত্তরা পূর্ব থানার সাবেক সভাপতি আল আমিন প্রধান (৩৩), নাসির (৩০), সুজন (৩০), রাফিন চৌধুরী (১৯), মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী আকলিমা (৩৫), যুবদল নেতা ইয়াছিন আরাফাত (৩২), নেত্রকোনা ছাত্রদল নেতা সজিব (২০), আব্দুল সালেক (৩০), রুবেল (২৫), বিল্লাল (৩৫), শহীদ (৪০), সাংবাদিক রাফসান জানি (৩৫), সিয়াম (২২), জসিম (৩৫), ছাত্রলীগ নেতা হাসানুর (২৭), রাসেল (৩৫), ছাত্রলীগ নেত্রী হিয়া (২০), মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সুফিয়া বেগম (৩৫), মাহবুবা বেগম (৫০), আজমান (২৫), খোকা আমিন (৫৪) ও নিলুফার নিলাকে (৪২) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সংঘর্ষ চলাকালে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানি, ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল, যুবদলের শফিকুল ইসলাম মিল্টন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান সারোয়ার, যুবদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শরিফ উদ্দিন জুয়েল, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য ইশরাক হোসেনসহ প্রায় দুই শতাধিক নেতা রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছেন। তাদেরকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

আহত ১৩ সাংবাদিক

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি সমাবেশের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে রাজধানীর কয়েকটি স্থানে সংঘর্ষে ১৩ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। বিজয়নগরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের ফটোসাংবাদিক সোহেল রেজা হামলার শিকার হন। দৈনিক বাংলা মোড়ে ফেসবুকে লাইভ করতে বিএনপির কর্মীদের হামলার শিকার হন ইত্তেফাক মাল্টিমিডিয়ার রিপোর্টার তানভীর আহমেদ। তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। দুপুর ১টার দিকে কাকরাইল তাবলীগ মসজিদ মোড়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে লাইভ করতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের হামলার শিকার হন ইত্তেফাক মাল্টিমিডিয়ার রিপোর্টার শেখ নাছের। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এছাড়া সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত হন ঢাকা টাইমসের প্রতিবেদক সিরাজুম সালেকীন। তার একটি পা ভেঙে গেছে। তাকে চিকিৎসার জন্য জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নেয়া হয়েছে। নিউ এইজ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি আহমেদ ফয়েজ, দৈনিক কালবেলার প্রতিবেদক রাফসান জানি, গ্রীন টিভির বিশেষ প্রতিনিধি রুদ্র সাইফুল্লাহ ও ক্যামেরাম্যান আরজু, ব্রেকিং নিউজের কাজী ইহসান বিন দিদার, আহসান হাবিব সবুজ, ইনকিলাবের ফটোসাংবাদিক এফ এ মাসুম, বাংলা ট্রিবিউনের সালমান তারেক শাকিল, দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদক আরিফুর রহমান রাব্বি, বাংলানিউজের জাফর আহমেদ, ফ্রিল্যান্সার মারুফসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) সভাপতি মির্জা মেহেদী তমাল ও সাধারণ সম্পাদক মামুনূর রশীদ অপরাধ প্রতিবেদন রাফসানের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেছেন।

যুবদল নেতার মৃত্যু

সংঘর্ষের পর সন্ধ্যায় রাজারবাগ কেন্দ্রীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শামীম মোল্লা নামে এক ব্যক্তি মারা যান। তিনি মুগদা থানা যুবদলের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক নম্বর ইউনিটের সভাপতি। তার বাড়ি ৭৭, পূর্ব মানিকনগর। শামীমের বাবা ইউসুফ মোল্লা পেশায় মুদি দোকানি। তিনি বলেন, তার ছেলে হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছেন। তার ছেলে ডা. লেলিন গাড়ি চালক। আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না।

রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক ডিআইজি রেজাউল হায়দার বলেন, মৃতের শরীরের কোনো আঘাতের চিহ্ন নাই। যেহেতু তার মৃত্যু একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে হয়েছে তাই লাশের ময়নাতদন্ত করা হবে।

 

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...