ছোটদের বড় খেলায় বাংলাদেশ

মোস্তফা কামাল,

  • প্রকাশিত: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:২২ পূর্বাহ্ণ

গরজে হোক, আর অমতে হোক বড়দের স্নায়ুযুদ্ধে অগ্রবর্তী দলের খেলোয়াড় হয়ে পড়ছে ছোট দেশগুলো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা কিছুটা পরিস্থিতির অনিবার্যতাও। বচনে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ বলা হলেও, বৈশ্বিক এ শীতল যুদ্ধে বাংলাদেশ একটু বেশিই ফ্যাক্টর। ভূ-রাজনীতিসহ নানা কারণে পূর্ব-পশ্চিম উভয়ের বিশেষ চাহনিতেও বাংলাদেশ।

বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় এ ধরনের টোকা বেশি ছিল দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আর এশিয়ার মধ্যে ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়াসহ কয়েকটি দেশে। এবার এশিয়ার মিয়ানমার থেকে পুরনো স্নায়ুযুদ্ধের মতো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। আগের স্নায়ুযুদ্ধকালে পরাশক্তিগুলো ছোট ছোট দেশগুলোকে নিজ বলয়ে নিয়েছে। সরকারের উত্থান-পতনও ঘটিয়েছে। এবারও কিঞ্চিৎ সেই নমুনা। মিয়ানমার-সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশে-দেশে নতুন ধাঁচে পুরনো খেলা। কে কাকে বুকে নিচ্ছে, পিঠ দেখাচ্ছে? নতুন এক দৃশ্য। মিয়ানমারের সমস্যা এখন আর মিয়ারমার সীমানায় নেই। দেশটির অভ্যন্তরীণ বারুদপোড়া গন্ধ ভারত-বাংলাদেশসহ আশপাশেও।

নতুন এ দৃশ্যপটে ভারতের হাত আরও শক্তিমান হচ্ছে, না এ উপমহাদেশ তাদের থেকে ‘ফসকে’ যাচ্ছে এ প্রশ্নও ঘুরছে। বলা নেই, কওয়া নেই প্রতিবেশীসহ আশপাশের দেশগুলো হিসাব-সমীকরণ ভেঙে এদিক-সেদিক ঝুঁকছে। পাকিস্তান গিয়ে দাঁড়িয়েছে মালদ্বীপের পাশে। ভারতবিরোধী অবস্থান নেওয়া মালদ্বীপকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনওয়ার উল হক কাকর। ভারতের বাজেটে মালদ্বীপকে সাহায্যের বরাদ্দে কিছুটা কাটছাঁটের ঠিক পর দিনই পাকিস্তানের ফোন মালদ্বীপে।

পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান আনওয়ার উল হক কাকর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মেহাম্মদ মুইজ্জুকে ফোনে অভয় দেন। বলেছেন, মালদ্বীপের উন্নয়নে অর্থসাহায্য করবেন। দেশ দুটিই চীনঘনিষ্ঠ। তাদের নিয়মিত অর্থ সাহায্য করে চীন। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ঘোরতোর চীনপন্থি। ক্ষমতায় বসেই চীন ঘুরে এসে মালদ্বীপের মাটি থেকে ভারতকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার আল্টিমেটাম দিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় হট আইটেম তিনি।

নেপালের সঙ্গেও ভারতের গোলমাল চলছে। নেপালের মানচিত্র পরিবর্তনের বিলের জের চলছে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে বিবদমান লিম্পিয়াধুরা, কালাপানি ও লিপুলেখ অঞ্চলকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার এ বিল প্রেসিডেন্ট বিদ্যাদেবী ভান্ডারী দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনুমোদনও করেছেন। নেপালের দীর্ঘদিনের বন্ধু ভারত এ বিলের অনুমোদন আটকে দিতে জোর তৎপরতা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। নেপালের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও চীনের গভীর সম্পর্ক। তাই স্বস্তিতে নেই ভারত। ভুটানও বসে নেই। ডোকলাম সীমান্ত নিয়ে চীন-ভুটান সম্পর্ক কোনদিকে যায় সেদিকে সতর্ক নজর ভারতের। আবার শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চীনের গভীর সম্পর্ক নিয়ে ভারত বরাবরই উৎকণ্ঠায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হচ্ছে, বিপরীতে ভারতের হস্তক্ষেপের প্রচারণাও জোরালো হচ্ছে। প্রবাসী কিছু বাংলাদেশির এ প্রচারণায় হাততালি দিচ্ছে দেশের ভেতরের কয়েকটি দল। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে। এই সম্পর্ক নিয়ে ভারত ভবিষ্যতে কী ভূমিকা নেয় তা দেখার অপেক্ষাও অনেকের।

বরাবরই এ ধরনের পরিস্থিতিতে চীন চিকন বুদ্ধিতে সাইডলাইন নেয়। রোহিঙ্গা সমস্যা ও মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়েও তাই করছে। বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছে, আবার মিয়ানমারের উভয় শক্তির সঙ্গেই মিতালি রাখছে। এর জের পোহাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। নতুন করে মিয়ানমারের একজন নাগরিককেও ঢুকতে দেবে না বলে সাফ কথা জানানোর পর এরই মধ্যে জান নিয়ে পালানো মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশকে আশ্রয় দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ভারতে ঢুকে পড়া মিয়ানমারের কিছু সেনা ও নাগরিককে পুশব্যাক করা হয়েছে। এ যন্ত্রণা কেউ নিতে চাচ্ছে না। সুদূর আটলান্টিকের ওপার থেকে পরিকল্পনা মতো খেলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা সেখানে বার্মা অ্যাক্ট বাস্তবায়ন থেকে এক চুলও সরছে না। সমস্যাটি এখন আর রাজনৈতিক থাকছে না। উপ-আঞ্চলিকতা মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে কৌশলগত বড় সার্কেলে। চলমান স্নায়ুদ্ধের বাইরেও বিশ্বের প্রায় ২৭টি দেশে যুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। কোনো কোনো যুদ্ধে সমরাস্ত্রের সঙ্গে অর্থনীতির উপাদান বেশি। কোথাও কোথাও বড়দের যুদ্ধের মধ্যে নাক-গলা ঢুকিয়ে ফেলছে ছোটরাও। কেবলই নাকই গলাচ্ছে না অ্যাক্টও করছে। পারফরম্যান্সও দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো দেশও রয়েছে সেই শরিকানায়।

পূর্ব-পশ্চিমের উত্তেজনা ও রশি টানাটানিতে বেনিফিশিয়ারি হওয়ার স্বপ্নও আছে কারও কারও। এরইমধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের এ সময়ে কে কখন কাকে কাছে নেয়, অভিনন্দন বা নিন্দা জানায় এর ঠিক-ঠিকানা নেই। নিশানা বদলাতে সময় লাগছে না কারোরই। তাইওয়ানের সাম্প্রতিক নির্বাচনে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তেকে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োকো কামিকাওয়ার বিবৃতি নিয়ে ঘটেছে বিপত্তি। এর তীব্র বিরোধিতা করেছে চীন। এর মাত্র ৭ দিন আগে বাংলাদেশের নির্বাচনকে দেশ দুটিই সমর্থন দিয়েছে, অভিনন্দন জানিয়েছে। বিশ্বজুড়ে চীনা দূতাবাসগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, যেসব দেশ তাইওয়ানের ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি)-কে সমর্থন করবে, তাইওয়ানের পুনর্নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লাই চিংকে অভিনন্দন জানানো বিদেশি সরকারগুলোর নিন্দা করতে।

চীনকে নিজ সীমানায় ব্যস্ত রাখার প্রচেষ্টা তাইওয়ানকে লিপ্ত করার আন্তর্জাতিক ও এশীয় খেলা চলছে। বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে তাইওয়ান কেবলই একটা দ্বীপ। আর লাই চিংকে একজন ট্রাবলমেকার এবং বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী। তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ডের অংশ মনে করে চীন। তাদের এ দাবি নতুন নয়। বরং শি জিনপিং এই একত্রীকরণের বিষয়টিকে একটি লক্ষ্যে পরিণত করেছেন। তাইওয়ানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর লাই চিং-তেকে এখন মঞ্চে বিজয় উদযাপন করতে দেখা যাচ্ছে। যা এশীয় অঞ্চলে আসল লড়াই বাধিয়ে দিয়েছে। এ অঞ্চলের বিশাল শক্তি ভারতের বশ্যতার জানান নতুন করে দিয়েছে বাংলাদেশ। আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে কথিত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে কিছুটা রিমেক করেছেন সদ্য নিযুক্ত নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেছেন, চৌদ্দ-আঠারোর মতো এবারের নির্বাচনেও বাংলাদেশের পাশে ছিল ভারত। জবাবে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, ভবিষ্যতে এ সম্পর্ক আরও উচ্চতায় যাবে।

এর বিপরীতে বাহ্যত বাংলাদেশের ভূমিকা মার্কিনবিরোধী। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে বেশ সাবধানীও। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও নতুন করে এসেছে মাকিনবিরোধী ঝাঁঝালো বক্তৃতা। বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমেরিকার লজ্জা নেই, তারা কখন কাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে তার ঠিক নেই। তাদের গোয়েন্দা সাক্ষ্যতেই তারেক রহমানের সাজা হয়েছে। এরা একজনকে এমন করবে, আবার কখন কাকে পছন্দ করে ক্ষমতায় নিয়ে আসে, তারও ঠিক নেই। এ রকম সময়েই বাংলাদেশের উন্নয়নে পাশে থাকার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠির মাধ্যমে নতুন উপাদান যোগ হয়েছে। দেশটি কখন কোন চ্যানেলে বা ফ্রন্টে এগোয় বাকিদের তা বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়।

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে যাওয়া রোধ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোম্যাসি এখন ওপেন সিক্রেট। এ ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতায়ই ১৯৬২ সালে কিউবা মিসাইল সংকট মোকাবিলা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। তিনি আরেকটি অনিবার্য পারমাণবিক যুদ্ধ রোধ করতে পেরেছিলেন ব্যাক চ্যানেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে। এবার ইয়েমেনে হুথিদের ওপর দ্বিতীয় দফা হামলা চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন, তারা ইরানকে হুথিদের ব্যাপারে একটা ‘গোপন বার্তা’ পাঠিয়েছে। লোহিত সাগর বন্ধ হলে নানা অসুবিধার পাশাপাশি বিচ্ছিন্ন লাভবান হওয়ার রাস্তাও হচ্ছে কোনো কোনো দেশের। যদিও বিশ্বে পূর্ব-পশ্চিম এবং রাশিয়া-ইরানের ভয়াবহ প্রক্সি ওয়ারে বলির পাঠা হওয়ার সমান্তরালে শেষ পর্যন্ত কারা কারা লাভবান হবে, সেই হালখাতা এখনই খোলা যাচ্ছে না।

ইয়েমেনের হুথি সরকার লোহিত সাগরে অব্যাহতভাবে পরিবহন জাহাজে আক্রমণ করায় যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ইয়েমেনে আঘাত হেনেছে। অন্যদিকে, হুথিরা মূলত ইরানের প্রক্সি। রাশিয়া গডফাদার। মধ্যপ্রাচ্যে এরা কয়েকটি দেশে শিয়া ইরানের মাধ্যমে ব্যাপক প্রক্সি গড়ে তুলেছে। রাশিয়া তার পশ্চিমাবিরোধী যুদ্ধও লড়ছে এসব প্রক্সি দিয়ে। ইউরোপ থেকে এশিয়ায় যত পণ্য পরিবহন হয়, তাদের একটি বড় অংশ আসে মিসরের সুয়েজ ক্যানেল হলে রেড সি বা লোহিত সাগর দিয়ে। লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার ইরানি ব্লকসহ ইয়েমেনের হুথিদের দিয়ে পুরো এই পথটাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। বিশ্বায়নের তোড়ে উগান্ডা থেকে রুয়ান্ডা, ভুটান থেকে বাংলাদেশ সবাই এর কম-বেশি শিকার।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
mostofa71@gmail.com

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...