মৌলভীবাজারে ২৫৭ জন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের যেসব জেলায় কুষ্ঠ রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম চা বাগান অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলা। ২০২৩ সালে এই জেলায় মোট ২৫৭ জন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১১ জন। যদিও কুষ্ঠ পরীক্ষার হার বাড়লে কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে জেলা সিভিল সার্জন অফিস জানায়, বর্তমানে এ জেলায় কুষ্ঠ রোগের পরিস্থিতি ভালো। চা বাগানসহ সন্দেহজনক এলাকায় পোর্টেবল এক্স-রে দিয়ে রোগী শণাক্ত করা হচ্ছে। অনেক রোগী শণাক্ত করে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কুষ্ঠমুক্ত মৌলভীবাজার করতে কাজ করছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।

সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কুষ্ঠরোগের একটি চিত্র তুলে ধরেছে কুষ্ঠরোগ নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা লেপ্রা। সংস্থাটির মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জের এরিয়া সুপারভাইজার জিয়াউর রহমান মৌলভীবাজারের কুষ্ঠরোগের অবস্থা নিয়ে বেশ আশঙ্কাজনক কিছু তথ্য জানিয়েছেন।

২০২১ সাল থেকে মৌলভীবাজারে কুষ্ঠরোগীদের নিয়ে কাজ করছে এই সংস্থাটি। মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কুষ্ঠরোগী শনাক্ত করার পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ক্যাম্পেইনও করছে তারা।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যে জানা যায়, ২০২২ সালে মৌলভীবাজারে মোট কুষ্ঠরোগী শনাক্তের সংখ্যা ছিল ১৯৩ জন। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫৭ জনে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়েছে কমলগঞ্জ উপজেলায়। এ উপজেলায় ২০২৩ সালে ৬৬ জন কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হন। একই বছর কুলাউড়ায় ৬২ জন, জুড়ীতে ৪৬ জন, শ্রীমঙ্গলে ৩৫ জন, বড়লেখায় ২৬ জন, রাজনগরে ১৭ জন এবং সদরে মোট ৯ জন কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হন।

চা শ্রমিকদের কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে জিয়াউর রহমান বলেন, মৌলভীবাজারে মোট শনাক্ত হওয়া কুষ্ঠরোগীর বেশিরভাগই পিছিয়ে থাকা চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। মোট কুষ্ঠরোগীর ৯৮ শতাংশই আসেন জেলার বিভিন্ন চা বাগান থেকে। এর অবশ্য আরেকটা কারণ আছে, চা বাগানগুলোতে সহজেই রোগীদের পরীক্ষার জন্য একত্র করা যায়। তাই পরীক্ষাও হয় বেশি। যে কারণে শনাক্তের হার চা বাগানে বেশি।

তিনি জানান, সিভিল সার্জনের উদ্যোগে পোর্টেবল এক্স-রে সুবিধা চালু করায় এখন এক্স-রে টিম নিয়ে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায়ও রোগী শনাক্ত করা হয়। টিমটি যেখানে যায়, সেখানে ক্যাম্পেইনও করে। আমরা সার্ভে বাড়াতে পারলে কুষ্ঠরোগী শনাক্তের সংখ্যা আরও বাড়বে।

মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তা মো. আব্দুল জাকারিয়া বলেন, জেলায় ২০২৩ সালে ২৫৭ জন কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসার আওতাধীন রয়েছেন ২১৭ জন। যাদের মধ্যে শিশু ১১ জন। দু’জন মারা গেছেন। বাকিরা সুস্থ হয়ে গেছেন।

আক্রান্তের এই সংখ্যা আশঙ্কাজনক বলে মনে করে তিনি আরও জানান, কুষ্ঠরোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে সিভিল সার্জন অফিসের উদ্যোগে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসকদের দল সার্ভে করছেন। সচেতনতা ক্যাম্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে জানানো হচ্ছে।

কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত রোগী বিনয় চাষা বলেন, আমার কুষ্ঠ হয়েছে এটা আমি নিজেও জানতাম না। শুধু পায়ে কিছু ঘা হয়েছিল দেখেছিলাম। ফার্মেসি থেকে এর জন্য ওষুধও কিনে খাই। কিন্তু, দীর্ঘদিন ওষুধ খাওয়ার পরও এই ঘা কমছিল না। অবশেষে, মৌলভী চা বাগানের এক ডাক্তার জানান যে, কুষ্ঠ হয়েছে। পরে তিনি আরও দু’জন ডাক্তার নিয়ে আসেন। তারা আমাকে চিকিৎসা দেন। প্রায় এক বছর ওষুধ খাই। এতে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠি। পরে আরও ছয় মাস ওষুধ খাওয়ার পর এখন মোটামুটি আমি সুস্থ আছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক মহিলা বলেন, আমার পিঠে প্রথম একটা দাগ হয়েছিল। সেই দাগ শুরুতে আমলে নেইনি। কিন্তু, দীর্ঘদিন পরেও যখন এটি কমছিল না তখন ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি জানান, আমার কুষ্ঠরোগ হয়েছে। তবে, এখন চিকিৎসাধীন আছি। ডাক্তার বলেছেন, ওষুধ খেলে কুষ্ঠরোগ ভালো হয়ে যায়।

চা শ্রমিকদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মিন্টু দেশোয়ারা। তিনি বলেন, চা শ্রমিকদের মজুরি কম থাকার ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে কম খাওয়ার ফলে তাদের অপুষ্টিতে ভুগতে হয়। ভালো পরিবেশে বসবাস না করার কারণেও তাদের মধ্যে কুষ্ঠরোগ হওয়ার হার বেশি। চা শ্রমিক পরিবারের কোনো সদস্যের কুষ্ঠরোগ হলে অন্যরা তা বুঝতে ও জানতে পারেন না। ফলে সংক্রামক ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি কুষ্ঠরোগী লজ্জা, ভয় ও সামাজিক বিপর্যয়ের কারণে এই ব্যাধি লুকিয়ে রাখেন বলে তিনি জানান।

জেলা সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মোর্শেদ বলেন, কুষ্ঠরোগে আক্রান্তের দিক দিয়ে দেশে শীর্ষ জেলা মৌলভীবাজার। বর্তমানে জেলায় যেসব রোগী রয়েছেন তাদের মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক বেশি। সংক্রামক এ রোগ সম্পর্কে বিভিন্ন কুসংস্কার রয়েছে।

অধিকাংশ রোগী সমাজ ও নিজের পরিবারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। চিকিৎসার পাশাপাশি রোগী ও তাদের পরিবারকে সচেতন করার কাজও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...