একাত্তরের নয় মাস (পর্ব-৩)

মতিয়ার চৌধুরী,

  • প্রকাশিত: ২১ মার্চ ২০২৪, ১:৩৫ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা

২৫মার্চ দিবাগত রাত তথা ২৬মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। এ ঘোষনাটি ইপিআর-এর নিকট পৌঁছানো হয় এবং তা ইপিআর বেতারের মাধ্যমে সারাদেশে প্রচার করা হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষনের কপি এবং বিভিন্ন জনসভায় দেয়া চারটি অডিও ভাষন থেকে এরকমই তথ্য পাওয়া যায়। সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষনাটি নিম্নরুপ।

“This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.

Sheikh Mujibur Rahman
26th March 1971”
Wireless Transmission
1. A Jalal Ahmed Chittagong
2. Manik Chowdhury Sylhet (Habiganj)
3. OC Abdul Hamid Pabna
4. Pakistan Posts & Telegrapg s Dept Kushtia
5. Others Later on

বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাটি চট্টগ্রামে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজের সেটেও ধরা পড়ে। শুনতে পান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখার প্রধান মেজর সিদ্দিক সালিকও। এছাড়া এবার্তাটি আরো কয়েকজন পেয়েছেন তারা হলেন ১. এ জালাল আহমেদ চট্রগ্রাম,২. মানিক চৌধুরী (হবিগঞ্জ) সিলেট- এখানে মানিক চৌধুরী বলতে হবিগঞ্জের কমান্ডেড মানিক চৌধুরী, ৩.পাবনার ওসি আব্দুল হামি,৪ পাকিস্তান পোষ্ট এন্ড টেলিগ্রাপ ডিপার্টমেন্ট কোষ্টিয়া, ৫. পরবর্তিতে আরো কয়েকজন।

ওয়্যারলেস বার্তাটি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জহুর আহম্মেদ চৌধুরী পেয়ে রাতেই তা সাইক্লোস্টাইল করে বিলির ব্যবস্থা করেন। পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ দুপুরে এ বার্তাটিই কালুরঘাট বেতার থেকে সর্বপ্রথম পাঠ করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান। তারপর বারবার ঘোষণাটি পড়ে শোনান অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ বিকেলে আবার পাঠ করে আবুল কাশেম স্বন্দীপ এর পর আরো কয়েকজন । ২৭মার্চ মেজর জিয়াকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার এ ঘোষণাটি পাঠ করানোর জন্য তাকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন তৎকালীন চট্টগ্রামের বেতার কর্মী বেলাল মোহাম্মদ, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহম্মেদ ও অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ।

২৭ মার্চ বিকেলে কালুরঘাট বেতার থেকে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। তা হলোঃ আমি মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করছি । জয় বাংলা। জিয়াউর রহমানের পর ঐদিন বিকেলে ঘোষনাটি আরো কয়েকজনে পাঠ করেন। ঢাকা শহরসহ গোটা দেশেই শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

এখানে উল্লেখ্য যে মেজর জিয়া জাতির পিতার পক্ষে স্বাধীনতার যে ঘোষনাটি পাঠ করেন ‘‘ তিনি পরিস্কার করে বলেছেন আমি মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠ করছি। জিয়া জীবিতাবস্থায় কোনদিনই দাবী করেননি যে তিনি স্বাধীনতার ঘোষক। এ বিষয়ে তিনি পরিবর্তিতে তার একটি লিখায় উল্লেখ করেছেন কিভাবে তিনি জাতির জনকের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠ করেন।

আর মেজর জিয়াকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষনাটি পাঠ করানোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণও ছিল যেহেতু দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, মানুষের মনবল যাতে অটুট থাকে একারণেই একজন আর্মি অফিসারকে দিয়ে ঘোষনাটি পাঠকরানোর ব্যবস্থা করেন বেতার কর্মিরা। ঘোষনা দেয়া আর পাঠ করা একই জিনিষ নয়।
এবিষয়ে পরবর্তিতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের কর্মকর্তা বেলাল মোহাম্মদ দেশস্বাধীনের পর সিলেট বেতারে বদলি হয়ে আসেন, তিনি সিলেট বেতারে কাজ করার সময় সিলেট বেতারে আমার পোগ্রাম করার সুবাদে তার সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয় এ বিষয়ে বেলাল মোহাম্মদের সাথে আমার কথা হয়, জানতে চাইলে তিনি এব্যাপারে যে কথা গুলো বলেছেন তা হলো, মেজর জিয়া প্রথমে আসতে চাননি পরে তাদের অনুরোধে তিনি ঘোষনাটি পাঠ করেন।

২৫ মার্চ মধ্য রাত থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঘোষনা অনুযায়ী দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ঘোষনা দেন পরদিন বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন।

এছাড়া আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচার করা হয় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন এবং তিনি মুক্ত আছেন। এখানে এর আরেকটি কারণও ছিল যাতে মানুষের মনবল না ভাঙ্গে একারণেই আকাশবাণী থেকে এমনটি প্রচার করা হয়। অন্য দিকে পাকিস্তান রেডিও থেকে প্রচার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
১০ই এপ্রিলের প্রবাসী সরকারের ঘোষনা পত্রে এবিষয়ে পরিস্কার ভাবে উল্লেখ রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গন্ধু স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন। জেনারেল এম এজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান করে গঠিত হয় মুক্তি ফোর্স, জিয়া ছিলেন সেক্টর কমান্ডার, আর একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি প্রবাসী সরকার থেকে নিয়মিত বেতন ভাতা নিয়েছেন। এছাড়া এখানে আরেকটি কথা পরিস্কার করা দরকার অবিংসবাদিত নেতা ছাড়া কেউ স্বাধীনতা ঘোষনা দিতে পারেনা, জাতির পিতা ছিলেন অবিংসবাদিত নেতা আর তিনিই স্বাধীনতার ঘোষনা দেন।

প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণেই পরোক্ষ ভাবে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন ‘‘ এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’’ আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে রুখে দাড়াও শত্রুর মোকাবেলা কর।

এর অন্যতম কারণ ছিল সাত তারিখ তিনি প্রকাশ্যে পরিস্কার করে ঘোষনা দিলে রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যেতেন আর এ কারণে বঙ্গবন্ধু কৌশল অবলম্বন করেছেন মাত্র। ৭ তারিখের বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর থেকে দেশব্যাপী মানুষ যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে, গ্রামে গঞ্জে শুরু হয় ট্রেনিং সমগ্র দেশে সাধারন মানুষ লাঠি সোটা নিয়েই পাকবাহিনীকে প্রতিহত করেছে এটিই সত্য। জিয়াউর রহমান যদি স্বাধীনতার ঘোষকই হতেন তাহলে তিনি মুক্তিবাহিনীর প্রধান হলেন না কেন? মেজর জিয়া যদি স্বাধীনতা ঘোষক হতেন তালে স্বাধীনতা বিদস হত ২৭ মার্চ? এবিষয়টি নিয়ে একটু ভাবলেই এই উত্তর পরিস্কার হয়ে যায়।

এছাড়া কালুরঘাট বেতার থেকে মেজর জিয়া জাতির পিতার পক্ষে যে ঘোষনাটি পাঠ করেছিলেন তার বিস্তিতি ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার এর বাইরে কেউ তা শুনতে পায়নি। সুতরাং স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে আর বিভ্রান্তি ছড়ানো উচিত নয়। এছাড়া জিয়াউর রহমানের পূর্বে যারা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠ করেছিলেন তাদের কেউতো ঘোষক দাবী করেননি। জিয়াউর রহমানও তার জীববদ্দশায় এটি দাবী করেননি, জিয়ার মৃত্যুর পর কেন এই প্রশ্ন উঠে আসল। আমাদের পরিস্কার করে বুঝতে হবে এর নেপথ্যে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি। (চলবে)

 

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...