একাত্তরের নয় মাস (পর্ব-৪)

মতিয়ার চৌধুরী,

  • প্রকাশিত: ২২ মার্চ ২০২৪, ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৫-এর পট পরিবর্তন ও ইতিহাস বিকৃতি

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধীরা প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পায়, শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতি। স্বাধীনতা বিরোধীরা জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি‘র কাঁধে বন্দুক রেখে অত্যন্ত সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করছে। মুক্তিযুদ্ধের পরজিত শত্রুরা জিয়াকে বানিয়েছে স্বাধীনতার ঘোষক ওসমানীকে বানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ন, জেনারেল ওসমানী ছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান বা প্রধান সেনাপতি, আর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জিয়া এবং জেনারেল ওসমানী জীবিতাবস্থায় কোনদিনই দাবী করেননি সর্বাধিনায়ক বা ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ধরে রাখতে হলে আমাদের সকলকে এসব অপ্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গঃ
বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচারের ধারাবাহিকতা এবং পাকিস্তানের সাথে অমিমাংসিত কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে পাকবাহিনী কর্তৃক নয় মাস ব্যাপী নারকীয় গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মুল কমিটি দাবী জানিয়ে আসছে, যৌক্তিক এদাবিটি বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে আন্তর্জাতিক ভাবে লবিং জোরদার করতে হবে।

বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দেশের শীর্ষ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলেও মানবতা বিরুধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত দু‘জন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী এখনও পালিয়ে রয়েছে। এদের একজন চৌধুরী মইনুদ্দিন অন্যজন আশরাফুজ্জামান, আফরাফুজ্জামান আমেরিকায় ও চৌধুরী মইনুদ্দিন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করে প্রকাশ্যে দেশ বিরোধী অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এই দুই যুদ্ধাপরাধীকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হলে ৩০লক্ষ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে এব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে, সেই সাথে এদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে সাজা কার্যকর করতে বৃটেন এবং আমেরিকায় বসবাসরত প্রতিটি প্রবাসী বাঙ্গালীকে এগিয়ে অসতে হবে।

এছাড়া পাকিস্তান আর্মির চিহ্নিত ১৯৫জন সেনা অফিসার যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল পাকিস্তান এদের বিচার করার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি সেই চিহ্নিত ১৯৫ জন ঘাতককে বাংলাদেশের কাছে বিচারের জন্যে হস্তান্তর করতে, পাকিস্তানের কাছে পাওনা আমাদের ন্যায্য হিস্যা, এবং যুদ্ধকালীন সময়ের ক্ষতিপূরন ও বাংলাদেশে আটকে পড়া ৩০লাখ পাকিস্তানী নাগরিককে এখনও পাকিস্তান ফেরত নেয়নি এসব কয়েকটি বিষয় অমিমাংসিতই রয়েই গেছে।

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মুল কমিটি সহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে দাবী উত্থাপিত হলেও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এর কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বিশ্বের অনেক দেশেই গণহত্যা হয়েছে এর বিচারও হয়েছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আজপর্যন্ত বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমরা পাইনি, এটি আমাদের ব্যর্থতা। রুয়ান্ডা আর্মেনিয়া সহ বহুদেশ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। নয়মাস ব্যাপী বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমরা আদায় করতে পারিনি। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মুল কমিটি আওয়াজ তুললে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবী জানিয়ে একটি প্রস্থাব পাঠানো হয়েছে ।

বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সরকারকে আরো বলিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। শহীদ জননী জাহানারা ঈমাম তার জীবদ্দশায় ২৫শে মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষনার দাবী জানিয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পর এনিয়ে জাতীয় সংসদে প্রস্থাব পাশ হয়। ২০১৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে ১৯৪৮ সালের কনভেশন অনুযায়ী ৯ইডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। আমাদের দাবী নয়মাস ব্যাপী বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম হেডকোয়াটার তেলিয়াপাড়া চাবাগানঃ
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তেলিয়াপাড়া চাবাগান ছিল যুদ্ধের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের অন্যতম অস্থায়ী বাজধানী বা মুক্তিযুদ্ধাদের মিলনকেন্দ্র। ২৫শে মার্চের পর অর্থাৎ মুবিজনগর সরকারের শপথ নেওয়ার আগ পযর্ন্ত জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী, কর্ণেল এম. এ. রব, সিআর দত্ত, খালেদ মোশার্রফ সহ মুক্তিবাহিনী প্রধানরা মিলিতি হতেন হবিগঞ্জের তেলিয়াপারা চা বাগানে, তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এখানে বসেই যুদ্ধের পরিকল্পনা করতেন। আর একারণেই তেলিয়াপাড়া ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম হেডকোয়াটার। বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার এই তেলিয়াপাড়া সীমান্তবর্তি হওয়াতে ত্রিপুরার সাথে যোগাযোগ ছিল সহজ আর একারণেই তেলিয়াপাড়াকে বেছে নিয়েছিলেন জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী।

দেশব্যাপী গণহত্যা ও নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় মানুষঃ
২৫শে মার্চ পাকিস্তান বাহিনী সারা দেশে অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশনা মাফিক দেশ ব্যাপী হত্যাযগ্য শুরু করলে, প্রাণ বাঁচাতে মানুষজন শহর ছেড়ে গ্রামে গঞ্জে আশ্রয় নেয়, অনেকেই সহায় সম্বল ফেলে পাড়ি জমায় ভারতে। দেশের কোন জায়গাই নিরাপদ নয়, সর্বত্র হত্যাযগ্য। ক্রমান্বয়ে এরা গ্রামে গঞ্জে চালায় গণহত্যা, প্রাণ বাঁচাতে মানুষজন সাময়িক নিরাপদ দেখে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। স্থানপরিবর্তন করে সমগ্রদেশের মানুষকে এভাবে নয় মাস কাটাতে হয়েছে। আমাদেরও ব্যতিক্রম হয়নি। মোট সাড়ে সাত কেটি বাঙ্গালীর মধ্যে এক কোটি মানুষ আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। আমাদের এলাকার মানুষজন বেশী আশ্রয় নিয়েছিল অসাম-ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যে। আমাদের আত্মীয় স্বজনরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে আমাদেরে বাড়ীতে আশ্রয় নেন। শুধু আমাদের বাড়ীই নয় প্রতিটি বাড়ীতে সম্গ্র দেশেই একই অবস্থা। মানুষজন একস্থান থেকে অন্য স্থানে সহায় সম্পদ ফেলে প্রাণে বাঁচার আশায় ছুটে চলছে। আমরাও আত্মরক্ষার্থে অনেক জায়গায় গিয়েছি। হত্যাযঙ্গ থামেনি পুরো নয়মাস ব্যাপী চলতে থাকে গণহত্যা। (চলবে)

(লেখক একজন স্বনাম খ্যাত সাংবাদিক-গবেষক, প্রেসিডেন্ট যুদ্ধাপরাধ বিচারমঞ্চ যুক্তরাজ্য শাখা, সাবেক সভাপতি ইউকেবাংলা রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাবেক সেক্রেটারী লন্ডনবাংলা প্রেসক্লাব, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মুল কমিটি যুক্তরাজ্য সাপ্টার।)

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...