সব
স্বদেশ বিদেশ ডট কম
।। হাসনাত আরিয়ান খান ।।
স্কুল, কলেজের পাঠ্য পুস্তকে তাঁর জীবনী নেই। বাংলাদেশে নেই,পশ্চিমবঙ্গে নেই, আসামে নেই, ত্রিপুরায় নেই, বিহারে নেই, উড়িষ্যায় নেই, আন্দামানে নেই, আরাকানে নেই। কোথাও তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে কোন আলোচনা নেই। কোথাও নেই। অথচ কোথায় ছিলেন না তিনি! ১৯৪৩ সালে তিনি অবিভক্ত বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে ছিলেন। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে তিনি আনজুমান মুফিদুল ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত থেকে মানবিক ও সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সংগ্রামে তিনি যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৯ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান,পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলের সংখ্যালঘু ও উদ্বাস্তুদের আশ্বস্ত করতে এবং তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে তিনি ঐতিহাসিক ‘নেহেরু-লিয়াকত’ চুক্তি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৫০ এর দশকে সুপ্রিম কোর্টে বিচারকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি রেড ক্রসের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি তাঁর মামা অবিভক্ত বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের সঙ্গে ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের জানাজায় অংশ নিয়ে তিনি ও তাঁর মামা দু’জনেই আটক হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধান সংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তানি সামরিক নেতৃত্বের বাধা মোকাবেলা করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করে বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। ১৯৬৬ সালের স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি ছয় দফার চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৬৭ সালে ছয় দফা আন্দোলন তুঙ্গে থাকাকালে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। মূলত মওলানা ভাসানী ও তাঁর কারণেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তরা নিঃশর্ত মুক্তি পেয়েছিলেন। আত্মমর্যাদাশীল বাঙালি জাতির প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৬৯ সালের গোলটেবিল সম্মেলনে তিনি “এক মানুষ, এক ভোট” নীতি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন। এই নীতিতে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠতার যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন আদায় করেছিলেন। এভাবেই তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিজয়ীদের জাতীয় সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি পান্জাবী শাসকগোষ্ঠীর পরাজয় নিশ্চিত করেছিলেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের অবৈধ সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। অবৈধ পান্জাবী শাসকচক্রের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। সাংবিধানিক ব্যত্যয়ে তিনি তৎকালীন হাইকোর্ট বারকে নিয়ে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তা এমন চরমে পৌঁছেছিল যে, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করাতে কোনো বিচারকই রাজি হননি। মুক্তিযুদ্ধের পরও তিনি থেমে যাননি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থেকে তিনি কখনো তিলমাত্র বিচ্যুত হননি। মুক্তিযুদ্ধের আগেও তিনি নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের দাবি করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরেও তিনি নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডের যেমন তিরস্কার করেছিলেন, তেমনি ভালো কাজের প্রশংসা এবং নানান পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে সার্ক গঠনের পরামর্শ তিনিই দিয়েছিলেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি তিনি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন এবং ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল ১৯৬৯ সালের ৩ এপ্রিল শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তিনি শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী হিসেবেই বেঁচে ছিলেন।
বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হওয়া সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। তিনি ১৯১১ সালের ১১ই জানুয়ারি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার স্মৃতিবিজড়িত মুর্শিদাবাদের এক সন্ত্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একজন কৃতী ছাত্র ছিলেন। স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিতে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। প্রবেশিকা পাসের পর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই তিনি ১৯৩১ সালে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। এরপর ১৯৩২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। ১৯৩৯ সালে তিনি বিলেতের লিনকন্স ইন থেকে ‘বার এট ল’ সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু শুধু পুঁথিগত বিদ্যা বা নিজ বিষয়ের জ্ঞান নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর পড়াশোনা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিধি ছিল বহুল বিস্তৃত। ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আইন, সমাজবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, ইংরেজি সাহিত্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তিনি একজন সুপন্ডিত ছিলেন। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি, আরবী, ফারসি, হিন্দী ও উর্দু ভাষায়ও তিনি সমান দক্ষ ছিলেন। ছাত্র জীবনেই তিনি বাংলা, ইংরেজি, ফারসি ও উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত লেখকদের উল্লেখযোগ্য বইগুলো পড়ে শেষ করেছিলেন। কলেজ জীবনেই তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ-ম্যাগাজিনের তিনি সম্পাদক ছিলেন। একই সময়ে তিনি তুখোড় বক্তা হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক দলেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কলেজ জীবনে তিনি ক্রীড়াক্ষেত্রেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। ১৯৩০ এর দশকে তিনি উপমহাদেশের বিখ্যাত মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ছাত্রজীবন শেষে তিনি একজন স্বাধীনচেতা লেখক হিসেবে সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেশ-বিদেশে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখছিলেন। বিখ্যাত ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় লেখালেখির জন্য তিনি গোটা উপমহাদেশে খ্যাতি পেয়েছিলেন। ‘গার্ডেন’ পত্রিকায় লেখালেখির জন্য তিনি মিসর, ফিলিস্তিনসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তিনি অন্য অনেক বিষয়ের মতোই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ইকবাল, শেক্সপিয়ার, শেলি, কিটস, টেনিসন, হাফিজ ও শেখ সাদির কবিতা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানের আধার ছিলেন। প্রতিটা লেখায় বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য, সূক্ষ্ম মননশীলতা, ব্যক্তিত্বের গভীরতা, পরিমিত রসবোধ, সুগভীর সাহিত্যপ্রীতি, শব্দের ব্যঞ্জনা ও ভাষার সাবলীলতা এবং পরিবেশ ও জ্ঞান সম্পর্কে চেতনাবোধ সর্বোপরি অকৃত্রিম মানবতাবোধে তিনি পাঠককে অভিভূত করেছিলেন। তিনি এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর পান্ডিত্য, মাহাত্ম্য ও ব্যক্তিত্বের জন্য অনেকেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত ছিলেন।
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ১৯৫৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আইনজীবী হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেও তিনি দক্ষ বিচারক হিসেবেই আকাশছোঁয়া খ্যাতি পেয়েছিলেন। তিনি নিছক আইনশাস্ত্র অনুশীলন করে আইনের টেকনোক্র্যাট হননি। আইন তাঁর কাছে কেবল কতগুলো বিধি ব্যবস্থা ছিল না। তাঁর জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসার পরিধি বহুধা বিস্তৃত ছিল। তাঁর আইনশাস্ত্রের পদ্ধতিও বাস্তববাদ, সাহসিকতা এবং প্রত্যয় দ্বারা চিহ্নিত ছিল। তাঁর মহিমা, দৃঢ় বুদ্ধি এবং দিগন্তের ওপারে দেখার অসাধারণ ক্ষমতার মধ্যে নিহিত ছিল। তিনি আইনকে ইতিহাসের মাপকাঠিতে, দর্শনের তুলনামূলক বিচারে ওজন করে নিতে পারতেন। আইনের পেছনেও যে ইতিহাস, সমাজ ব্যবস্থা ও দর্শন বিদ্যমান, তিনি তাঁর মূলে সহজে ও অবাধে বিচরণ করতে পারতেন। সকল প্রকার লোভ-লালসা ও ভয়-ভীতির উর্ধে থেকে তিনি বিচার কাজ পরিচালনা করতেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারব্যবস্থার মর্যাদা সমুন্নত রাখার ব্যাপারে তিনি আপসহীন ছিলেন। একারণে তিনি দলীয় রাজনীতিতে কখনো জড়াননি। দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করেননি। বিচারকের মর্যাদা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য তিনি কঠোর প্রয়াস চালিয়েছিলেন। একজন বিচারক হিসেবে তিনি তাঁর আজীবন স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি নিম্ন আদালতের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বিচার বিভাগের আধুনিকায়ন, অগ্রগতি ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য তিনি নিজের নিরলস প্রচেষ্টায় পদে থাকার মাত্র চার বছরের মধ্যে বিচার ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন। আমাদের সমাজের মৌলিক বাস্তবতা এবং আমাদের প্রেক্ষাপটে কীভাবে আইন পরিচালনা ও প্রয়োগ করা উচিত তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করতে এবং সংখ্যালঘুদের সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনি হাইকোর্ট থেকে সুয়োমোটো/স্বঃপ্রণোদিত রুল জারি করেছিলেন। নির্বাহী ক্ষমতা খর্ব করতে এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে তিনিই প্রথম উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন চালু করেছিলেন। তাঁর সাহসের ফলে শেখ মুজিবুর রহমানসহ গ্রেপ্তার হওয়া নেতৃস্থানীয় বাঙালি রাজনীতিবিদদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। স্বৈরশাসনের মধ্যেও তিনি সুনীতি ও সুবিবেচনার প্রতীক হিসেবে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। পেশাগত চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সমাজে ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পথনির্দেশকের ভূমিকা পালনের জন্যে তিনি আইনজীবীদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়েছিলেন। আইনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মর্যাদা তিনি অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পক্ষে তাঁর অখণ্ড অবস্থানের প্রমাণ রেখেছিলেন। অসত্য, অসুন্দর ও অকল্যাণের বিপরীতে তিনি সর্বদা মজলুমের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। বিচারক জীবনে তিনি অসংখ্য জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঐতিহাসিক ও সময়োপযোগী রায় দিয়ে আইনের শাসন সমুন্নত রেখেছিলেন। অকৃত্রিম মানবতাবোধে, বিচার ও বিশ্লেষণের নিপুণতায়, মত প্রকাশের স্পষ্টতায় ও বলিষ্ঠতায়, জীবন দর্শনের গভীরতায়, সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠায়, বঞ্চিতের প্রতি সমবেদনায়, শব্দ-বিন্যাসে, ভাষার স্বাচ্ছন্দ্যে ও গতিশীলতায় পান্ডিত্যপূর্ণ এই রায়গুলোর জন্য তিনি শুধু জাতীয়ভাবে নয়, আর্ন্তজাতিকভাবেও প্রশংসতি হয়েছিলেন। জাতিসংঘের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল কুট ওয়ার্ল্ড হাইমসের মতে, তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা বিচারক ছিলেন। তিনি বিচারকদের আইকন ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি আসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি শুধু একজন আইনবিদ ও বিচারপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন যথার্থ সংস্কতিবান ব্যক্তিত্ব, যিনি বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত থেকে সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন।
বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ গণতন্ত্রী ছিলেন। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে তিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন। তিনি রাজনীতিক ছিলেন না, কিন্তু দেশের সমস্ত নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি সংবাদ পত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, চিন্তা ও লেখার স্বাধীনতা না থাকলে সমাজে কোন মূল্যবোধই অবশিষ্ট থাকবে না। এক সময় গোটা সমাজ সর্বনাশের অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। শিক্ষাঙ্গনের কলুষিত পরিবেশ দেখে তিনি শিক্ষাগত মূল্যবোধের জাগরণে ছাত্র, শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদদের একসাথে দাঁড়াতে বলেছিলেন। তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন যুদ্ধ করেছিলেন। দেশের প্রতিটি কঠিন সংকটে গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে না দিয়ে তিনি তাঁর বিশ্বাস প্রজ্ঞা, আভিজাত্য, সুবিবেচনা ও সাহস দিয়ে সকল সংকট মোকাবিলা করেছিলেন। আজকে দেশে বিচারের নামে, গণতন্ত্রের নামে, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার নামে, সংস্কৃতির নামে, শিক্ষার নামে, উন্নয়নের নামে, সমাজকল্যাণের নামে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে যেসব ঘটনা ঘটছে, এই একটি মানুষ থাকলে তার প্রতিবাদে ঠিকই রুখে দাঁড়াতেন।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রূপকার বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে মহান নেতা শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু, মওলানা ভাসানী ও আবুল হাশিম প্রমূখ পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে নিয়ে যে সম্মিলিত স্বাধীন বাংলা/ অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা/অখণ্ড স্বাধীন বাংলা/বৃহত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখেছিলেন (যার ইতিহাস অন্ততঃ চার হাজার বছর পুরোনো), তিনি তা সমর্থন করেছিলেন। একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি হিসেবে তিনিও তাঁর মামা শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের মতই বাংলা বিভাগের ঘোর বিরোধী ছিলেন। অবিভক্ত বাংলা পরবর্তীতে ব্রিটিশ চক্রান্তে বিভক্ত করা হলেও বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করা যায়নি। আজও আমরা একই ভাষায় কথা বলি, একই খাবার খাই, আমাদের সংস্কৃতি এক, আজও আমাদের আকাশ এক, আজও আমাদের স্বপ্ন এক। আজও আমরা অবিভক্ত বাংলা/অখন্ড বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। আজও প্রায় একই দাবিতে আমরা যখন লড়ছি এবং সংগঠিত হচ্ছি, তখন একজন সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের অভাব আমরা অনুভব করছি। মৃত্যুর পর থেকে তিনি কালের পরিক্রমায় তাঁর অভাবকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন,‘আমি মারা যাওয়ার পরেও আমার আত্মা বারের আশপাশে ঘুরে বেড়াবে।’ আমরা তাঁকে আদালতের ভেতরে খুঁজছি, আদালতের বারান্দায় খুঁজছি, রাজপথে খুঁজছি, টেবিল আলোচনায় খুঁজছি, শান্তিতে খুঁজছি, সংগ্রামে খুঁজছি, শহর, নগর, বন্দর সব জায়গায় খুঁজছি। কোথায় পাবো তারে!
লেখক: গবেষক, আহবায়ক (Convenor) – অখন্ড বাংলাদেশ আন্দোলন (United Bengal Movement); ইমেইল: info_khan@ymail.com
Developed by: Helpline : +88 01712 88 65 03