সব
মো. মোশারফ হোসেন সবুজ,
ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় অপেক্ষমান একটি মোটর সাইকেল, একটি প্রোইভেট কার এবং একটি মাইক্রোবাসকে ব্রেক ফেল করা ফিটনেসবিহীন একটি বাস পেছন থেকে ধাক্কা দিলে দুই পরিবারের ছয়জন নিহত হওয়ার খবর অথবা, সাভারে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকাগামী একটি অ্যাম্বুলেন্স সড়ক বিভাজকের সাথে ধাক্কা খেলে পেছন থেকে দুটো বাস অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে ধাক্কা দেয়, আর এতে অ্যাম্বুলেন্সে আগুন ধরে গেলে আরোগ্যপ্রত্যাশী বাচ্চাছেলে ফুয়াদ, তার মা,বাবা,খালা এ চার জন পুড়ে মারা যান এ খবর, না ছোট্ট মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে সড়কের পাশে থাকা বালুতে পিছলে গিয়ে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পুরনজিত হালদারের মৃত্যুর খবর – সাম্প্রতিক এ দুর্ঘটনার সংবাদগুলোর কোনটি আমাদের মনে বেশি দাগ কাটে? আসলেই কি দাগ কাটে? দাগ কাটলে কতটুকু? নাকি, আদৌ এ সব দুর্ঘটনার খবর শুনতে-শুনতে আমাদের অনুভূতি তৈরি হওয়ার জায়গাটি অভ্যস্ত আর ভোঁতা হয়ে গেছে?- অথবা, আমরা এসব ঘটনা শুনে মন খারাপ অবস্থা থেকে পালিয়ে থাকতে চাই, কারণ এসব ঘটনার কারণে আমাদের মনোজগতে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তাকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দিলে আমরা মানসিক বৈকল্যের শিকার হতে বাধ্য হবো?
বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইলেও বাস্তবতাতো বাস্তব-ই। বাস্তবতা তাহলে কী? বাস্তবতা হলো এই যে, এদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এবং এতে প্রাণহানীর হার আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালে আমরা সড়কে ৭.২৯৪টি প্রাণ হারিয়েছি (বেসরকারি বিভিন্ন সংস্হার হিসেবে আরো অনেক বেশি লোক প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান)। সরকারি হিসাবকে ‘সত্য’ বলে ধরে নিলে প্রতিদিন তাহলে গড়ে কতজন সড়কে প্রাণ হারান? প্রায় ২০ জন ! আরো ৪০ জন পঙ্গুত্ব বরণ করেন। আহত নিহত বেশিরভাগই কর্মক্ষম মানুষ, সংসারের হয়তো একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আজও সড়কে ২০ জন প্রাণ হারাবেন। এ হিসাবে ঢুকে যেতে পারি আমিও। আপনিও এ তালিকায় যোগ যুক্ত হবেন না, এ ভরসা দেয়ার লোক আপনার আশেপাশে নেই।
আজ ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫ পর্যন্ত দেশে এইচএমপিভি (একধরণের ভাইরাস)-তে একজন মহিলার মৃত্যু হয়েছে, সেটি আলোচনায় বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে, কিন্তু আজ ২০ জন লোক সড়কে মারা গেলে সেটি ২০ ভাগের এক ভাগ গুরুত্বও পাবে না। কিন্তু, সড়কে এত দুর্ঘটনা-এত প্রাণহানীর কারণ কী, বুঝতে গেলে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের যাঁদের এ বিষয়গুলো বোঝার কথা তাঁরা সত্যিকারের বিশেষজ্ঞ তাই তাঁরা কারণগুলো বুঝতে পারেন না আর তাই, তাঁরা সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারেন না ( বুঝতে পারলে নিশ্চয়ই করতেন)। বিশেষজ্ঞ না হয়ে আপনি এ দেশে যা যা বুঝতে পারবেন, বিশেষজ্ঞ হলো তার অনেকটাই আপনি বুঝবেন না। আপনি অথবা আমি একবার যদি চালকের আসনে বসে একটি গাড়ি নিয়ে একবার ব্যস্ত সড়কে চক্কর মেরে আসতে পারি, দেখবেন বেশিরভাগ কারণই আমরা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, আমরা কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করার যেহেতু ক্ষমতা রাখি না, তাই সড়কের দৃশ্যমান প্রাণঘাতী অব্যবস্থাপনা আমাদের হতাশায় নতুন মাত্রা যোগ করতেই থাকবে। যাঁরা পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য দায়িত্ব নিয়ে আছেন, তাঁরা ওগুলো খালি চোখে দেখার জন্য কখনোই চালকের আসনে বসবেন – এমনও মনে হয় না।
সড়কের বিভিন্ন ধরণের ত্রুটি সড়ক দুর্ঘটনার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। যে ডিভাইডারগুলো সড়কে বসানো হয় সেগুলো কোথায় শুরু হচ্ছে, আর কোথায় শেষ হচ্ছে, আপনি বুঝতে পারবেন না- প্রয়োজনীয় সাইন বা সংকেত না থাকার কারণে। রাতের বেলা বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির বাতির আলোতে আপনি বিভাজকগুলো দেখতেও পাবেন না অনেক সময়। রোড মার্কিং না থাকার কারনে আপনি তো ডিভাইডারে ধাক্কা খাবেন-ই। স্ত্রী সন্তানসহ জ্বলে পুড়ে মরার ভাগ্য এ ডিভাইডার গুলো তৈরি করে দিতে পারে যে-কাউকে। ডিভাইডারগুলোতে রিফ্লেক্টর ব্যবহার করলে রাতের বেলা চালক ডিভাইডারের অস্তিত্ব বুঝতে পারবেন। চালক সাবলীলভাবে গাড়ি চালাতে পারবেন।
মহাসড়কে নাকি সিএনজি অটোরিক্সা নিষিদ্ধ। সিএনজি অটোরিক্সা আমরাতো দেখি দূরপাল্লার ট্রিপেও যায়! এ ছাড়াও যখন-তখন যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে পড়া, নিজেদের মধ্যে ওভারটেকিং প্রবণতা এবং ব্রেকলাইট, ব্যাকলাইট-সহ প্রযোজনীয় বাতি ব্যবহার না করা সিএনজিগুলো সড়ককে বিপজ্জনক করে তুলে। সিএনজি অটোরিক্সার পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত বিক্সাগুলোও বেপরোয়া। সিএনজি অটোরিক্সা বা ব্যাটারিচালিত রিক্সাগুলো ভারী বা দ্রুতগামী যানবাহনকে ঘনঘন ধৈর্যের পরীক্ষায় ফেলে। দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়া বড় গাড়ির একজন চালক সড়কে এসব অবৈধ যানের শৃঙ্খলাবিহীন চলাচলের কারণে অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে পারেন যেটি আরেক জায়গায় দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
সড়কে প্রয়োজনীয় সাইন বা সংকেতের অভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। কোথাও স্পিড ব্রেকার আছে কি-না, আগে থেকে আপনার বোঝার সুযোগ নেই। কোন সড়কে আমি কী পরিমাণ গতিতে যাবো তার নির্দেশনা কদাচিৎ চোখে পড়লেও সেই নির্দেশনাটি কতদূর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে অর্থাৎ কতটুকু জায়গা আমাকে নির্দেশিত গতিতে যেতে হবে, তার উল্লেখ নেই। রোড মার্কিং সবখানে না থাকায় নির্দিষ্ট লেনের ভেতবে গাড়ি চালানোর কোনো বাধ্যবাধকতা তৈরি হয় না। একবার রোডমার্কিং করলে দেখা যায় কিছুদিন সেগুলো এতোটাই মলিন হয়ে পড়ছে যে, এগুলো আর দৃষ্টিগোচর হয় না।
যানবাহনগুলো ইদানিং বাতি ব্যবহারে এমন স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন করছে যে, কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রচণ্ডরকম উদাসীন তা-ই যেনো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে। হেডলাইট না জ্বালিয়ে মাঝখানে দুটো এলইডি গুচ্ছ-লাইট ব্যবহার করছে বড় আকারের অনেক যানবাহন। হেডলাইট না থাকায় বিপরীত থেকে আসা গাড়ি রাতের বেলায় ঐ গাড়ির আকার নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়লে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। বাজারে যানবাহনের জন্য সস্তায় পাওয়া অনুপযুক্ত ও অবৈধ বাতিগুলো সড়ককে আরো দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলে। নীল ও সবুজ বাতি কীভাবে যানবাহনে ব্যবহার হওয়ার সুযোগ পায়, ভাবলে আপনি আবার হতাশ হবেন।
আপনি একটু অভিজ্ঞ হলেই সড়কে কী পরিমান আনফিট গাড়ি – দেখতে পাবেন- ইয়ত্তা নেই। পিক-আপ, বাস, ডায়না-ট্রাক আনফিট গাড়ির তালিকাকে দীর্ঘ করতে বৃহৎ ভূমিকা রাখবে। তারপরও এগুলো চলছে। প্রতিদিন ২০ জন মরছে আরও ৪০ জন পঙ্গুত্বকে বরণ করছে কি এমনিই!
মোটর সাইকেল আর সিএনজিগুলো সুযোগ পেলেই ডানে বায়ে যে কোনো দিকে ওভারটেক করতে চায়, বড় যানবাহনের ব্লাইন্ডস্পটে চলে আসে যখন-তখন, যেনো আত্মাহুতির জন্য মরিয়া হয়ে আছে তারা!
আমরা নিরাপদ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সড়ক চাই। ট্রাফিক আইন না- -জানা ব্যক্তিদেরকে চালক হিসেবে দেখতে চাইনা। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং ফিটনেস সার্টিফিকেট স্টিকার হিসাবে প্রকাশ্য স্থানে লাগানোর ব্যবস্থা হোক। ধীরগতির ছোট যানবাহনগুলো বড় গাড়ির সড়ক থেকে সরিয়ে ফেলা হোক। সস্তা আবেগকে এখানে পাত্তা দিলে প্রাণ দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। সড়কগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে সমস্যা কী? সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে পারলে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদেরকে সহজে শনাক্ত করা যাবে। অবৈধ যানবাহন সড়কে চলছে কি-না তাও বোঝা যাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ডিজিটাইজড হয় না কেনো – এ এক রহস্য।
প্রাণের দামের সাথে অন্য কোনো যুক্তি চলে না, অন্য কোনো যুক্তি তাই এক্ষেত্রে বিবেচনায়ও আসতে পারে না। আমি এ লেখার শুরুতে বলেছি, প্রতিদিন ২০ জন মারা যাচ্ছেন সড়কে। সিলেট বিভাগে প্রতিদিন একাধিক ব্যক্তি এ তালিকায় যুক্ত হন। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ৩৭৫।
আরেকটি কথা, রাস্তায় নির্মাণ-সামগ্রী রাখা বে-আইনি কাজ। বে-আইনি কাজগুলো দেখার জন্য পরিষ্কার চোখের মানুষ চাই। আইন না মানতে-মানতে আমরা আইনের বিরুদ্ধাচরণ করি। সাধারণ মানুষ এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। দায়িত্বে থেকেও মানুষকে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য সক্রিয় ভূমিকায় থাকে না, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নেয়ার মানুষ কি আছে?
লেখক : ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক, বড়লেখা নারীশিক্ষা একাডেমী ডিগ্রি কলেজ।
Developed by:
Helpline : +88 01712 88 65 03