নাফেরার দেশে চলে গেলেন বিশ্বনাথের মরমী সাধক শাহ খোয়াজ মিয়া

মতিয়ার চৌধুরী, লন্ডন,

  • প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২৫, ৮:২৬ অপরাহ্ণ

‘লাগাইয়া পিরিতের ডুরি/আলগা থাকি টানে-রে /আমার বন্ধু মহাজাদু জানে-রে।’ এই গানটির রচয়িতা বাউল খোয়াজ মিয়া আজ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। (ইন্না..লি..ল্লা..হি.. রাজিউন)। খোয়াজ মিয়া চলে গেলেও তাঁর রচিত গানের এই মাঝেই তিনি বেঁছে থাকবেন ভক্তদের মাঝে।
এর বাইরেও তিনি সিলেটী ভাষায় অসংখ্য গান লিখেছেন, যেমন ‘আমার এসব বিদ্যার দরকার নায়/যে বিদ্যা হয় ঘুষখোর মদখোর, স্বার্থপর সমাজ ঠকায়।/ হইতে চাই না জজ-ব্যারিস্টার, হইতে চাই না উকিল মুখতার/হইতে চাই না ডাক্তার মাস্টার, যাই না স্কুল মাদরাসায় । /মৌলানা মৌলবি যারা, শিক্ষা দেয় না টাকা ছাড়া/হিত কর্মে স্বার্থ করা, এসব শাস্ত্রের বিধান নায়। /যে বিদ্যায় সুখ-শান্তি বিরাজে, আনন্দ পায় লোক সমাজে/ আমি পড়ি সেই কলেজে, কয় অধীন খোয়াজ পাগেলায়।’ সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দৌলতপুরে এক নিম্নমধ্য বৃত্ত পরিবারে ১৯৪২ সালের ১২ মার্চ খোয়াজ মিয়ার জন্ম।

বাল্যকাল থেকেই শখের বসে গ্রামের রাস্তায় গান গেয়ে ঘুরে বেড়াতেন। একসময় এই শখ পরিণত নেশায়। গান তাঁকে এতটাই আকর্ষন করত যে, স্কুলের লেখাপড়ায় মন বসত না। এই নেশাই তাঁকে বাউল বানিয়েছে। সেই শিশুকাল থেকেই তাঁর ভাবনা-চিন্তা, আচার-আচরণ ছিল ব্যতিক্রমী। সংগীতের প্রতি প্রবল আকর্ষন নেশা ছিল একধনের উন্মাদনা । রক্ষনশীন সমাজে জন্ম নেয়া খোয়াজ মিয়া এলাকায় তিনি গান গাইতে পারতেন না। তাই সকলের চোঁখ ফাঁকি দিয়ে গানের মাঝে ডুবে থাকতেন কখনো চলে যেতে যেতে দূরে বহুদূরে । বাবার চোঁখ ফাঁকি দিয়ে সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন পাশের গ্রামের গানের আসরে। বাঁশি বাজাতে পছন্দ করতেন। গানের প্রতি প্রবল ভালবাসার আকর্ষণের কারণে লেখাপড়া থেমে যায় ক্লাস থ্রি পর্যন্ত । প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে এখানেই। একসময় মরমি সাধক দুর্বিন শাহের শিষ্যত্ব বরন করেন।
’বিভিন্ন আসরে নিজ কন্ঠে গেয়েছেন রাধারমণ, আরকুম শাহ, হাছন রাজা সহ মরমী সাধকদের রচিত অসংখ্য গান। , পিতা ছিলেন খুবই পরহেজগার, তাই বাড়িতে কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন না, এমনকি প্রিয় বাঁশিটিও না। তাই মনের দুঃখে নৌকা নিয়ে হাওরের মাঝখানে গিয়ে সংগীত সাধনায় ডুবে থাকতেন। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে বিভোর, তখন নীরবে গান লিখতেন। কখনো বা পুকুরপাড়ে নিরালায় বসে কথার ফুল কুড়াতেন। গানই তার ধ্যান-প্রেম। কিন্তু গানের জন্য পরিবারসহ এলাকাবাসীর নানা কটূক্তি শুনতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। এক কথায় বলতে হয় পরিবার আত্মীয় স্বজন এমনকি প্রতিবেশীদের অপমান লাঞ্চনাই তাঁকে বাউল বানিয়েছে।

কেউ অপমান করলে তখনই গেয়ে উঠতেন ‘যার গান গাইলে শান্তি মিলে /শীতল হয় মোর পোড়া বুক।/নিষেধ কইরো না পাড়ার লোক।/শুনব না গো নিষেধ মানা/ না দেখে পাগল হইছি না।/কে আছ গো দরদপানা/আনিয়া দেখাও চান্দও মুখ।/ দেখিলে তার আজব ছবি/বেশি পাগল তোরা হবি। /না গাইলে তার প্রেমের কবি /অন্তরে পাবে না সুখ।/কয় খোয়াজ মন বাঁধব কীসে/মরলাম গো তার প্রেম বিষে।/বিষ কিংবা নিঃষে/চরণে আমায় রাখুক।’
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আশপাশের গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মহাজনি, মালজোড়া গান গাইতেন কৈশোর থেকেই। কিন্তু দুর্বিন শাহের শিষ্যত্ব লাভের প্রত্যাশায় প্রহর গুনতেন। সিদ্ধি লাভের আশায় ত্যাগের পথে পা বাড়িয়ে অবশেষে পেলেন গুরুর সন্ধান। ১৯৬২ সালে ২২ বছর বয়সে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে যাত্রা করেন দুর্বিন টিলার উদ্দেশে। গুরুর আশীর্বাদের ছায়াকে অবলম্বন করে শুরু হলো তার নতুন পথচলা
কিশোর বয়স থেকেই মালজোড়াসহ নানা ধরনের গান রচনা করে গাইতেন। তবে একনিষ্ঠ মনে চর্চা করতে থাকেন দুর্বিন শাহের সান্নিধ্যে এসে। স্রষ্টাপ্রেমে নিজেকে সমর্পণ করে নির্মোহ জীবনের স্বাদ নিতে উপদেশ দিলেন দুর্বিন শাহ। তার সব আদেশ, নিয়ম কানুন শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে সাধনায় মগ্ন হলেন।
শিখে নিলেন পরমাত্মার অন্বেষণ, অধ্যাত্মসাধনাসহ জীবনের নানা প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করার কৌশল। আত্মমুক্তির সন্ধানে যে গানটি সব সময় গুনগুন করে গাইতে থাকেন বেশী প্রেমাগুনে দেহ আত্মা, করো ভাজা ভাজা/দুই নয়নের জল দিয়া, বুকের বসন ভিজা।/নগরবাসী আছে খুশি, পাইয়া গুণের মজা/খোয়াজ মিয়ার শেষ হলো না, প্রেমের মানুষ খোঁজা।

সেসময় গ্রামে একমাত্র খোয়াজ মিয়াই গান গাইতেন, তবে শরিয়তকে মূল্যায়ন করে। বিভিন্ন আসরে বাউল গানের শিল্পীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। আবদুল খালিক, আপ্তাব মিয়া, হেকিম, আলী হোসেন সরকার, সফর আলী, সৈয়দ আলী, মুজিব সরকার, মফিজ মিয়া, ফকির শমসুল, বিশ্বনাথের চান মিয়া এবং নেত্রকোনার চান মিয়ার সঙ্গে মালজোড়া গানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন খোয়াজ মিয়া। মালজোড়া গানে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেছিলেন বেশ কবার। সংসারের ঘানি টেনেও ৭৭ বছর বয়সে এসে গানকে সঙ্গী করেই বেঁচে রয়েছিলেন তিনি। কেবল গান গাওয়া ও লেখার মধ্যেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি, একজন মহৎ হৃদয়ের পরোপকারী ব্যক্তিও বটে। দিনের কর্মশেষে নিরলে ডুবে থাকেন পরকালের ভাবনায়। মানবধর্ম, মানবদেহ, মানবআত্মা, মানবজীবন, মানবগুরু ও মনুষ্যত্ব সম্পর্কে তার কৌতূহলের শেষ নেই। মানবদেহের মধ্যেই রয়েছে মন, আত্মা, চৈতন্য, জ্ঞান, আবেগ, অনুভূতি। জাগতিক মোহে, রিপুর তাড়নায় তিনি বিব্রত। তাই নিজের অজ্ঞতা, অক্ষমতার প্রকাশ করেছেন গানে। কখনো করছেন আত্মসমালোচনা। ‘যোগী ঋষি পীর আউলিয়া, ধন্য হইল নাম জপিয়া/লইল না নাম খোয়াজ মিয়া, পড়িয়া কুন্ডমতীর ফেরে।/রং দেখিয়া খোয়াজ মিয়া, রঙের পাগল হইছে/রঙে-ঢংয়ে প্রেম তরঙ্গে, নানান বেশে নাচে।’
বাউল খোয়াজ মিয়া রচিত গান গেয়েছেন দেশের খ্যাতিমান শিল্পিদের অনেকে উল্লেখযোগ্যরা হলে কণ্ঠশিল্পী ডলি সায়ন্তনী, শিমুল খান, ফোক গানের যুবরাজ সৈয়দ আশিকুর রহমান আশিক, সাজ্জাদ নূর ছাড়াও বেশ কজন। গুণীশিল্পিদের কয়েকটি অ্যালবামের শিরোনামও হয়েছে তার গানের বাণী।
সরল জীবন, সহজ ভাবুকতা তাকে শক্তি জুগিয়েছে। প্রতিটি মানুষের অন্তরেই একটি সুপ্ত বাসনা থাকে। একসময় এসে তা প্রকাশ করার তাগিদ অনুভব করেন প্রত্যকেই। কেউ প্রকাশ করেন রংতুলির আঁচড়ে, কেউ কবিতায়, কেউ ছবিতে, কেউবা গানে। খোয়াজ মিয়াও এর ব্যতিক্রম নন। মহান সাধকদের মতো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে উদার, মানবিক, প্রেমময়, শান্তিপূর্ণ এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন তিনিও। তারও রয়েছে মনের রঙিন ইচ্ছাগুলোকে গানের কথায় প্রকাশ করার বাসনা। সবগুলো গান একই মলাটে দেখার স্বপ্নে বিভোর তিনি। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত গেয়ে যেতে চান।

আমি যখন সিলেট অঞ্চলে গ্রামে গঞ্জে ঘুর ঘুরে মরমী সাধকদের নিয়ে আমার গ্রন্থ ‘’ সিলেটর মরমী সাহিত্যে রাধাকৃস্নের প্রভাব‘‘ রচনা করি তখন বাউলদের নিয়ে কাজ শুরু করেন সিলেট বাউল কল্যাণ সমিতির প্রেসিডেন্ট গীতিকার ও রাজনীতিক কামাল উদ্দিন রাসেল। বাউল সংগঠন কামাল উদ্দিন রাসেলের মাধ্যমে আমার পরিচয় ঘটে এই খোয়াজ মিয়ার সাথে। তার দুটি গান রেকর্ড ও করেছিলাম।
সহজ সরল বাউল খোয়াজ মিয়াকে তখনই আমার ভাল লেগেছিল । আমার দৃষ্টিতে খোজায় মিয়া সত্যিকারেরই একজন খোদা প্রেমিক। সারা জীবন গানের মাধ্যমে সস্ট্রাকে সৃষ্টির মাঝে খঁজেছেন এই বাউল। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। সেই খোয়াজ মিয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে সিলেট বিভাগ বাউল কল্যাণ সমিতি সহ সকলেই এগিয়ে আসবেন এই প্রত্যাশায় লিখার ইতি টানছি।

এই সম্পর্কিত আরও খবর...