তিন হাজারের বেশী কবর খোঁড়া মনু মিয়া না ফেরার দেশে

মতিয়ার চৌধুরী,

  • প্রকাশিত: ২৮ জুন ২০২৫, ৭:৪৩ অপরাহ্ণ

পারিশ্রমিক ছাড়া তিন হাজারের বেশি কবর খোঁড়া কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আগলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মনু মিয়া চলে গেলেন নাফেরার দেশে। আজ ২৮ জুন ২০২৫ নিজ বাড়ীতে তিনি ৬৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন (ইন্না…লি..ল্লা.হি.রাজিজুন)।
মৃত্যুর পর মানুষের স্থায়ী ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া মনু মিয়ার মৃত্যুতে এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। শুধু এলাকাই নয় যারা মনু মিয়িা সম্পর্কে জানতেন সকলেই মর্মাহত। আমিও এই মানুষটির মৃত্যুসংবাদ শুনে দারুন ব্যথিত হয়েছি। তাঁর সাথে আমার ব্যাক্তিগত কোন পরিচয় নেই, কোন দিন দেখিওনি। যা জেনেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মনু মিয়া ছিলেন না সমাজের কেউ কেঠা বা নামীদামী মানুষ্ । তাঁর পরিচয় একজন গোর খোদক। আর্থিক অবস্থাও তেমন স্বচ্ছল ছিলনা। সম্বল বলতে ছিল সামান্য ধানী জমি এবং জয়সিদ্ধি বাজারে ৩টি দোকান ঘর। নিজের জমি এবং এই দোকান ঘরের ভাড়াতেই চলতো সংসার। নিঃসন্তান মনুমিয়ার ছিলনা কোন উচ্চাবিলাস।
আগলাপাড়া গ্রামের মরহুম আব্দুল হেকিমের ৩ পুত্রের মধ্যে মনুমিয়া ছিলেন দ্বিতীয়। মনুমিয়ার ছোট ভাই কয়েকবছর আগেই মারা গেছেন। বেঁচে আছেন তার বড় ভাই মোঃ সায়েদ মিয়া। পারিবারিক সূত্রে জানা যায় ২৮ জুন বাংলাদেশ সময় সকাল নয়ঘটিকায় নিজ বাড়ীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। বিকেলে পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মনু মিয়া দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। ছয় দিন আগে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে তাকে বাড়িতে নেওয়া হয়। ঘোড়ার পিঠে চড়ে কবর খোঁড়ার জন্য বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যেতেন মনু মিয়া। অসুস্থ হয়ে তিনি যখন হাসপাতালে শয্যায়। দুর্বৃত্তরা মেরে ফেলেছে তার ঘোড়াটিকে। অসুস্থার কারনে এই খবরটিও তাঁকে দেয়া হয়নি। বাড়ীতে এসে জানতে পারেন।
স্থানীয়রা জানান, কারও মৃত্যুসংবাদ শুনেই ঝড়বৃষ্টি কিংবা রাত-বিরাত উপেক্ষা করে খুন্তি, কোদালসহ প্রয়োজনীয় খনন যন্ত্রপাতি নিয়ে মনু মিয়া ঘোড়ায় করে ছুটে যেতেন কবরস্থানে। মানুষের অন্তিম যাত্রায় কবর তৈরি করতেন পরম যত্নে। ৫০ বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে কাজটি করেছেন তিনি। এ জন্য কোনো সুবিধাও তিনি নেননি। মনু মিয়ার ডায়েরিতে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এই দীর্ঘ সময়ে তিনি অন্তত ৩,০৫৭টি কবর খুঁড়েছেন। এ পর্যন্ত যাদের কবর খুঁড়েছেন, তাদের মৃত্যুর দিন-তারিখ সব লিখে রেখেছেন। কবর খুঁড়তে দূরের যাত্রায় দ্রুত পৌঁছাতে নিজের ধানি জমি বিক্রি করে কয়েক বছর আগে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন মনু মিয়া। ঘোড়াটি সচল রেখেছিল তাকে। বাড়িতে মনু মিয়া ও তার স্ত্রী রহিমা বেগমের অনুপস্থিতিতে ঘোড়াটিকে মেরে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই মনু মিয়াকে দামি ঘোড়াসহ নানা সহযোগিতা করতে চান। কিন্তু মনু মিয়া কারও সহায়তা নিতে রাজি হননি। তিনি শুধু সবার কাছে তাঁর সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছিলেন, আবার যাতে অন্যের জন্য কবর খুঁড়তে পারেন।
লন্ডনে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মনুমিয়ার মৃত্যু সংবাদ দেখে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। লন্ডনে বসবাসরত কিশোরগঞ্জের সন্তান সর্বমহলে পরিচিত ড. আনিছুর রহমান আনিছের মাধ্যামে তার বিস্তারিত জানতে পারি। তিনিও এলাকাবাসি হিসেবে এই মানুষটির মৃত্যুতে ব্যাথিত। ড. আনিছ জানান মনুমিয়া ১৬/ ১৭ বছর বয়স থেকেই মুনুষের কবর খুড়তে শুরু করেন, এটি ছিল তাঁর ব্যাতিক্রমী এক শখ । মনুমিয়া বলতেন, আমার কোন সন্তান নেই আমি যা করছি আল্লাহকে খুশি করার জন্য। দুনিয়ায় আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। আমাদের সকলকেই পৃথিবীর নিয়ম মাফিক একদিন চলে যেতে হবে। মহান আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা তিনি যেন তার এই বান্দাকে জান্নাতের সর্বোচ্ছ মোকাম দান করুন আমীন।

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

Developed by: Web Design & IT Company in Bangladesh