‘বিদ্রোহী’ : জাতীয় জাগরণের ঘোষণাপত্র

মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন,

  • প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২৫, ৩:১৬ অপরাহ্ণ

কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি (১৯২২) উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব এবং নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ওর ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ তত্ত্বের আলোকে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। নগুগি তার তত্ত্বে দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক শাসনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো শোষিত জাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়কে বিকৃত করা। এর ফলে তারা নিজেদের হেয় মনে করতে শুরু করে এবং উপনিবেশকারীর ভাষা ও সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এই মনস্তাত্ত্বিক দাসত্বের বিরুদ্ধে কঠিন আঘাত।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ওর মতে, ভাষা উপনিবেশবাদের একটি প্রধান অস্ত্র। ঔপনিবেশিক শক্তি নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করে এবং উপনিবেশিত জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিকে হীন ও নিকৃষ্ট হিসেবে তুলে ধরে। এর ফলে, উপনিবেশিত জাতি ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয় হারাতে থাকে। কাজী নজরুল বিদ্রোহী কবিতায় অত্যন্ত সচেতনভাবে এই ভাষা-ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক রেখায় গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতিসত্তার পরিচয় তুলে ধরেছেন।

নগুগির ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ তত্ত্বের মূলকথা হলো, উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রকৃত লড়াই শুরু হয় মনস্তাত্ত্বিক মুক্তি থেকে। আর এই মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ নিজের ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে আবার দাবি করা। ব্রিটিশ শাসকেরা ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষাব্যবস্থা ও উচ্চতর জ্ঞানের মাধ্যম হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছিল। ফলে ভারতীয়রা নিজেদের ভাষাকে অবজ্ঞা করতে শুরু করে। নজরুল বিদ্রোহী কবিতায় এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন—

এক. পশ্চিমা মিথ ও প্রতীক বর্জন: নজরুল এ কবিতায় পশ্চিমা মিথ বা পৌরাণিক চরিত্র (যেমন গ্রিক বা রোমান দেব-দেবী) ব্যবহার করেননি। যেখানে সেই সময়কার অনেক সাহিত্যিক পশ্চিমা সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিলেন, সেখানে নজরুল সচেতনভাবে স্থানীয় মিথের দিকে ফিরে এসেছেন। তিনি নিজেকে ‘ইন্দ্রাণী-সুত’, ‘কৃষ্ণ-কণ্ঠ’, ‘ব্যোমকেশ’ (হিন্দু মিথ) এবং ‘ইস্‌রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার’, ‘বেদুঈন’ (মুসলিম মিথ) বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, স্থানীয় সংস্কৃতিতে বিদ্রোহ ও বীরত্বের পর্যাপ্ত উপাদান রয়েছে এবং বিদেশি সংস্কৃতির কাছে ঋণ গ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই।

দুই. বহু-সাংস্কৃতিক ভাষার ব্যবহার: নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় ব্যবহৃত ভাষা কেবল বাংলা নয়, বরং এটি আরবি, ফার্সি, হিন্দি ও উর্দু শব্দের এক শক্তিশালী সংমিশ্রণ। যেমন: ‘চির-উন্নত মম শির’ (শির: ফার্সি), ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ (খোদা: ফার্সি, আরশ: আরবি), ‘হর্দম’ (ফার্সি), ‘জাহান্নাম’ (আরবি) ইত্যাদি। এই মিশ্র ভাষা ব্যবহার করে তিনি প্রমাণ করেছেন, এই অঞ্চলের মানুষের পরিচয় কোনো একক ধর্ম বা ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণে গড়ে ওঠা এক সমন্বিত জাতিসত্তা। এটি পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের ‘বিভক্ত ও শাসন করো’ (divide and rule) নীতির বিরুদ্ধে এক অসামান্য প্রতিবাদ।

নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ভাষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে একটি নতুন জাতিসত্তা গড়ে তুলেছেন, যা পশ্চিমা হেজেমনির বিরুদ্ধে এক সাহসী মনোজাগতিক লড়াইয়ের প্রতীক। তিনি শিখিয়েছেন, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বুকে ধারণ করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেই কেবল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় সম্ভব।

বিভিন্ন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, যেমন বাঁশের কেল্লা, খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলন—রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এসব আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ছিল যে, তারা জনগণের মনোজাগতিক দাসত্ব থেকে মুক্তির ওপর যথেষ্ট জোর দেয়নি। নগুগি তার ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড গ্রন্থে যুক্তি দেন যে, একটি জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হয়, যখন সে তার সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়। ঔপনিবেশিক শক্তি প্রথমেই উপনিবেশিত মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের ভাষাকে ছোট করে দেখে এবং নিজেদের ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চাপিয়ে দেয়। ফলে মানুষ নিজের সত্তাকে ঘৃণা করতে শেখে এবং শাসককে অনুকরণ করতে শুরু করে।

নজরুল এই মনস্তাত্ত্বিক দাসত্বের মূল ধরে আঘাত করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূল উদ্দেশ্য কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, বরং পরাধীন মানুষের মনকে জাগিয়ে তোলা। কবিতার শুরুতেই ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির!’—এই উচ্চারণ কোনো রাজনৈতিক স্লোগান নয়, দাসত্বের পর আত্মমর্যাদাবোধের প্রথম জাগরণ। এটি ঔপনিবেশিক শক্তির সামনে নতজানু না হয়ে বরং মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর এক দৃপ্ত ঘোষণা। নগুগির মতে, এই আত্মমর্যাদাবোধের উন্মেষই উপনিবেশ-মুক্তির প্রথম সোপান।

নগুগি বিশ্বাস করতেন, উপনিবেশকারীরা যখন কোনো জাতিকে শাসন করে, তখন শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণই করে না, বরং শোষিত জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভাষাকেও ধ্বংস করে। নজরুল তার কবিতায় এই মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।

নজরুল যখন বলেন, ‘আমি মানি না কো কোন আইন,/ আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি,/ আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!’ তখন তিনি কেবল ব্রিটিশ সরকারের দমনমূলক আইনকেই নয়, বরং ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থা দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া সমস্ত নিয়ম-কানুন, প্রথা ও শৃঙ্খলকে প্রত্যাখ্যান করেন। নগুগির মতে, এই নিয়মগুলো ছিল সাংস্কৃতিক দাসত্বের হাতিয়ার। নজরুল তার বিদ্রোহী সত্তার মাধ্যমে সেই দাসত্ব ভেঙে ফেলার আহ্বান জানান। তিনি দেখান, স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কেবল যুদ্ধই নয়, নিজেদের মন থেকে দাসত্বের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে।

নগুগি যেমন উপনিবেশকারীর ভাষা ত্যাগ করে নিজের মাতৃভাষায় লেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তেমনি নজরুল বাংলা ভাষায় এমন এক কবিতা লিখেছিলেন, যা হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। নজরুল তার কবিতায় হিন্দু ও মুসলিম উভয় সংস্কৃতির পৌরাণিক প্রতীক ও চরিত্র ব্যবহার করে একটি সমন্বিত পরিচয় গড়ে তুলেছেন। ‘আমি ইন্দ্রাণী-সুত’, ‘আমি কৃষ্ণ-কণ্ঠ’, ‘আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার’, ‘আমি বেদুঈন’—এই ধরনের মিশ্রিত প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি ঔপনিবেশিক ‘বিভক্ত ও শাসন করো’ নীতির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এই সাংস্কৃতিক ঐক্যের পুনর্গঠন নগুগির ডিকলোনাইজিং মাইন্ড তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

নগুগি তার তত্ত্বে উপনিবেশিত জাতির ‘আত্ম-আবিষ্কার’ (self-discovery) প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় এই প্রক্রিয়াকে রূপকভাবে তুলে ধরেছেন। কবিতার শেষাংশে কবি বলেন, ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!’—এই পঙ্‌ক্তি কেবল কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, এটি সমগ্র জাতির আত্ম-আবিষ্কারের প্রতীক। এটি পরাধীনতার দীর্ঘ অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার পর নিজের প্রকৃত শক্তি ও সত্তাকে চেনার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। যখন জাতি নিজেদের সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে, তখনই নিজেদের পরিচয় খুঁজে পায়।

কবিতার শেষ স্তবকে নজরুল বিদ্রোহের চূড়ান্ত লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন: ‘মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত / আমি সেই দিন হব শান্ত, / যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না – / অত্যাচারীর খড়্‌গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –’। এই পঙ্‌ক্তিমালা কেবল ব্রিটিশ শাসন থেকে রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলে না, বরং সকল শোষণ, জুলুম ও নিপীড়ন থেকে মানবজাতির সামগ্রিক মুক্তির কথা বলে। এটি নগুগির তত্ত্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, যেখানে বলা হয়েছে, প্রকৃত মুক্তি কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ নয়, শোষণমুক্ত ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এর প্রধান লক্ষ্য।

পরিশেষে বলা যায়, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক মনোজাগতিক বিপ্লবের প্রতীক। নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-র ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড তত্ত্বের আলোকে এর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই কবিতাটি কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার আহ্বান জানায়নি, বরং উপনিবেশিত মানুষের মনকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে তাদের আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ফিরিয়ে আনার এক শক্তিশালী প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এটি প্রমাণ করে, প্রকৃত স্বাধীনতা আসে মন থেকে এবং সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং আত্মমর্যাদার এক কঠিন বোধ।

সূত্র : আমার দেশ

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

Developed by: Web Design & IT Company in Bangladesh