সব
মতিয়ার চৌধুরী-লন্ডন,
গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শুক্রবার বাংলাদেশের একটি অবাক করার ঘটনা বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন ঘটনা বিশ্বের আর কোথাও ঘটেছেকি-না আমার জানা নেই। এঘটনাটি দেখে কি বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তৌহিদি জনতার ব্যানারে ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটির নামে যারা এমনটি ঘটিয়েছে তাদের পোষাক দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় এরা মুসলমান, আর এই মুসলমান নামধারী তৌহিদি জনতা মুসলমানদের পবিত্র দিন জুমাবারে একজন মুসলমানের লাশ কবর থেকে তুলে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে? শুধু তাই নয়, মাজার এবং পীরের আস্তানটিও লুট পাট শেষে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। সেই সাথে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং পুলিশের গাড়িতে হামলা করেছে।
২০২৪ এর আগষ্টের পর থেকে বাংলাদেশে এই তৌহিদি জনতা নামধারী গ্রুপটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এরা একের পর এক অঘটন ঘটিয়ে যাচ্ছে, এব্যাপারে ড. মুহম্মদ ইউনুসের সরকার সম্পুর্ন নীরব! কোন কোন ঘটনায় সরকারের মৌন সমর্থনও রয়েছে এমন দাবী আক্রান্তদের । আসলে কে এই তৌহিদি জনতা এই প্রশ্ন দেশবাসীর? গোয়ালন্দের হামলাকারীদের পরিচয় থাকা সত্বেও পুলিশ অজ্ঞাত কয়েক হাজার মানুষকে আসামী করে মামলা করেছে। কারা এই হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে প্রশাসনের জানা সত্বেও কেন হামলাকারীদের আসামী করা হচ্ছে না , বা গ্রেফতার করা হচ্ছেনা?
যার লাশটি কবর থেকে তুলে তৌহিদি জনতা নাম ধারীরা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। তার আসল নাম নূরুল হক হলেও তিনি মানুষের কাছে ‘নূরা পাগলা‘ নামে পরিচিত। এক সময় তিনি ঢাকা হাইকোর্ট মাজারে থাকতেন। সমগ্র বাংলাদেশে তার ভক্ত অনুসারীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তিনি একজন বাউল ধারার সূফী সাধক।
বাংলাদেশে আইএস এবং তালেবানের আদর্শে গঠিত জঙ্গি সংগঠন গুলো সুফিবাদের ঘোর বিরোধী। এরা মাজারে বিশ্বাস করেনা, বাউল ধারার সুফীদের এরা ইসলামের শত্রু মনে করে। বাংলাদেশে একসময় জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটলে বিগত সরকার কঠোর হস্তে জঙ্গি দমন করে। শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশে জঙ্গিরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কেউ কারাগার থেকে পালিয়ে গেছে কোন কোন জঙ্গিকে অন্তবর্তি কালীন সরকার জামিনে মুক্ত করে দিয়েছে। বাংলাদেশের কয়েকটি ইসলামিক রাজনৈতিক দল জঙ্গিদের পৃষ্টপোষকতা করে আসছে। এরা বাংলাদেশে প্রকাশ্যে ইসলামী রাজনীতি করার সুযোগে এদের আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্ক বেশ শক্তিশালী।
বাংলাদেশের এমন কয়েকটি ইসলাসী রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা রয়েছেন যারা আশির দশকে সরাসরি বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তানে গিয়ে তোলেবান বাহিনীতে যোগ দেয় পরবর্তিতে বাংলাদেশে ফিরে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে মিশে গেছে।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে তৌহিদি জনতা নামধারী হামলাকারীদের দাবি নূরা পাগলা নিজেকে ‘ইমাম মাহাদি’ দাবি করতেন। আসলে তাই নয় তিনি প্রচার করতেন খুব দেরী নয় ‘ইমাম মাহদী‘ আসবেন আর তিনি তার অনুসারীদের এই বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। হামলাকারী তৌহিদি জনতা তার কথার অপব্যাখা দিয়ে নুরুল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলার’ মরদেহ কবর থেকে তুলে রাস্তায় এনে প্রকাশ্যে উল্লাস করে আগুন পুড়িয়ে দিয়েছে। এর আগে সেখানকার দরবার শরিফ ও বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন তৌহিদি জনতা। এতে দরবারের ভক্ত, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশসহ ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। এ সময় ভাঙচুর করা হয় ইউএনওর গাড়ি, পুলিশের দুটি গাড়ি।
শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জুড়ান মোল্লাপাড়ায় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদুর রহমান। এদিন জুমার নামাজের পর ঈমান আকিদা রক্ষা কমিটির ব্যানারে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফকির মহিউদ্দিন আনসার ক্লাবে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন গোয়ালন্দ উপজেলা ইমাম কমিটির সভাপতি মাওলানা জালাল উদ্দিন যিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের রাজবাড়ি জেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত নেতা। গোয়ালন্দ উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আইয়ুব আলী খান, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মন্ডলসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা দরবারের দিকে যেতে চাইলে প্রশাসন তাদের নিবৃত করার চেষ্টা করে। এ সময় গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সরকারি গাড়ি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসির গাড়ি ভাঙচুর করে হামলাকারীরা। আহত হন ৫ পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় প্রশাসনের ২ জন। হামলায় মৃত্যু হয় একজনের।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, মিছিল নিয়ে প্রথমে নুরুল হকের আস্তানার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। তখন দরবারের লোকজন ইটপাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করলে অপর পাশ থেকেও ইটপাটকেল ছোড়া হয়। একপর্যায়ে কয়েকশ লোক দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে দরবারে হামলা চালান। এ সময় ভক্তদের কয়েক জনকে বেধড়ক পেটানো হয় এবং নুরুল হকের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। পরে নুরুল হকের লাশ কবর থেকে তুলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ বাসস্ট্যান্ডের অদূরে পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলায় উভয় পক্ষের অন্তত অর্ধশত লোক আহত হন। পরে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস থেমে থেমে কাজ করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাড়িতে দরবার শরীফ গড়ে তোলেন নুরুল হক। গত ২৩ আগস্ট বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় মারা যান নুরুল হক। ওই দিন রাতে কফিন সহ তার লাশটি কবর দেয়া হয়। মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় কবরটি উচু করা হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কবর সমতল করাসহ কয়েকটি দাবি জানায় স্থানীয় আলেম সমাজ।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলন করে নুরুল হকের দরবারে অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ করে উপজেলা ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। তারা বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর সমতলসহ বিভিন্ন দাবি জানায়। অন্যথায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ ও পরে ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয়।
এই কর্মসূচি ঘিরে জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশ আলেম-ওলামা ও দরবার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিক সভা করে। শুক্রবার সকালে রাজবাড়ী জেলা জামায়াতের আমির অ্যাড. নুরুল ইসলাম ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা দরবার শরীফ পরিদর্শন করেন। এসময় তারা দরবার কর্তৃপক্ষ শর্ত পূরণ করেছে বলে জানান। জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অ্যাড. নুরুল ইসলাম বলেন, দাবির মধ্যে কবর নিচু করা হয়েছে। তবে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজকের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হবে এবং মূল দাবি মেনে নেওয়ায় আগামী শুক্রবারের ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’সহ অন্যান্য কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।
এদিকে শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গোয়ালন্দ প্রেসক্লাবে দরবারের ভক্তরা সংবাদ সম্মেলন করে জানান, আলেম-ওলামাদের দাবির প্রেক্ষিতে গোয়ালন্দ দরবার শরীফের পীর নুরাল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলা’র কবর উঁচু থেকে নিচু করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে দরবারে ইসলামের সব নিয়ম কানুন পালন করা হয় দাবি করে ভক্ত মেহেদি আল আমিন বলেন, আলেম ওলামাদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় ‘নুরাল পাগলা’র কবর উঁচু থেকে নিচু, কবরের দেয়ালের রঙ পরিবর্তন ও ইমাম মেহেদি দরবার শরিফ লেখা সাইনবোর্ড অপসারণ করা হয়েছে। এছাড়া এখানে মুসলমান ও সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাড়া এখানে কেউ আসে না।
উল্লেখ্য, গত ২৩ আগস্ট ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুরুল হক ‘নুরাল পাগলা’র মৃত্যু হয়। এরপর তার প্রতিষ্ঠিত গোয়ালন্দ দরবার শরীফের ভেতরে মাটি থেকে কিছুটা উঁচু বেদিতে তাকে দাফন করা হয়। এরপর থেকে কবর নিচু, রঙ পরিবর্তন ও ইমাম মেহেদি দরবার শরিফ লেখা সাইনবোর্ড অপসারণের দাবি তোলেন ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। এ বিষয়ে গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নাহিদুর রহমান জানান, আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে বাড়ি ও দরবারে হামলা করে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এসময় ইউএনওর সরকারি গাড়ি ও পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আহতের সংখ্যা এখন বলা যাচ্ছে না। গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি মো. রাকিবুল ইসলাম জানান, এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটবে তা ধারণা করা যায়নি। হামলায় রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজিব আহত হন। এছাড়াও ৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে রাজবাড়ীর এসপির নেতৃত্বে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র্যাব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. শরিফুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে ২২ জন আহত রোগী এসেছেন। তারমধ্যে তিনজনকে ভর্তি করা হয়েছে এবং ১৯ জনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে/ সরকারের বিবৃতি
এদিকে গোয়ালন্দে নুরুল হক মোল্লা, যিনি নুরাল পাগলা নামেও পরিচিত, তাঁর কবর অবমাননা ও মরদেহে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই অমানবিক ও ঘৃণ্য কাজটি আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের আইন এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সভ্য সমাজের মৌলিক ভিত্তির ওপর সরাসরি আঘাত। এই ধরনের বর্বরতা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এবং প্রতিটি মানুষের জীবনের পবিত্রতা, জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা জনগণকে আশ্বস্ত করছি যে এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা হবে এবং আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনা হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। যারা এই ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে দ্রুত ও কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, ঘৃণা ও সহিংসতাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করুন, সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোন এবং ন্যায়বিচার ও মানবতার আদর্শকে সমুন্নত রাখতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা গড়ে তুলুন। আসলেই কি মাজারে হামলাকারীদের গ্রেফতার করা হবে না সরকারী এই প্রেসনোটে হামলাকারীদের আড়াল করার চেষ্ঠা ?