সব
স্বদেশ বিদেশ ডট কম
ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষকেরা মনে করছেন, এই সাতটি সরকারি কলেজের জন্য যে প্রক্রিয়ায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেটি বাস্তবায়িত হলে শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতির মুখে পড়বে।
ওই সব কলেজের শিক্ষকেরা বলছেন, এতে শিক্ষার্থী কমে গিয়ে উচ্চশিক্ষা সংকোচন হবে, বাড়বে বৈষম্য। বিশেষ করে ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে নারী শিক্ষার সুযোগ কমে যাবে। কলেজগুলোর শিক্ষকদের পদ-পদবি নিয়েও জটিলতার সৃষ্টি হবে।
এ জন্য তারা চান প্রস্তাবিত কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় না করে পৃথক ক্যাম্পাস স্থাপন করে এই ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হোক। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রস্তাবিত ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ থাকতে পারে।
বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সামনে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচিতে এসব কথা বলেন ওই সাত কলেজের শিক্ষকরা। এতে কয়েক শ শিক্ষক অংশ নেন।
ঢাকার এই সাতটি কলেজ একসময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। কলেজগুলো হলো— ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।
২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর এই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু অধিভুক্ত করার পর থেকে যথাসময়ে পরীক্ষা নেয়া, ফলাফল প্রকাশসহ বিভিন্ন দাবিতে সময়-সময় আন্দোলন করে আসছিলেন এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত জানুয়ারিতে এই সাত কলেজকে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করার কথা জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে এই সাত কলেজের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
ঢাকার বড় সাতটি সরকারি কলেজের জন্য নতুন যে বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাচ্ছে, তাতে এখনকার মতো একেকটি কলেজে সব বিষয় পড়াশোনা হবে না। সাতটি কলেজকে চারটি স্কুলে বিভক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এর মধ্যে স্কুল অব সায়েন্সের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাস; স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউমিনিটিসের জন্য সরকারি বাংলা কলেজ এবং স্কুল অব বিজনেসের জন্য সরকারি তিতুমীর কলেজ; স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিসের জন্য কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ক্যাম্পাস নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘হাইব্রিড মডেলে’ চলা নতুন ধরনের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ শতাংশ ক্লাস হবে অনলাইনে আর ৬০ শতাংশ ক্লাস হবে সশরীর। তবে সব ধরনের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে সশরীর।
মানববন্ধনে শিক্ষকরা বলেন, জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, গবেষণা শক্তিশালীকরণ এবং ধাপে ধাপে সম্মান কোর্সে রূপান্তরের কথা বলা হলেও প্রস্তাবিত নতুন কাঠামো তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
তাদের ভাষ্য, ‘এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থীদের স্বল্প খরচে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হবে। পুরান ঢাকায় উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নির্ভরযোগ্য কবি নজরুল কলেজ রূপান্তরিত হলে দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উত্তর ঢাকায় যেতে হবে, যা শহরের যানজটে নতুন সংকট তৈরি করবে।’
নারীশিক্ষার প্রসঙ্গ তুলে তারা বলেন, ‘ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ দীর্ঘদিন ধরে নারীদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠান সংকুচিত হলে রক্ষণশীল ও পর্দানশীন পরিবারের মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষা বাধাগ্রস্ত হবে, যা সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদ, জাতীয় শিক্ষা নীতি এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG ৪.৩ ও ৪.৪)-এর পরিপন্থী।’
তারা আরও বলেন, ‘যদি সকল অংশীজনের মতামত ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত না করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়, তবে ইডেন কলেজের সাম্প্রতিক আন্দোলনের মতো বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে।’
অন্যদিকে, সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার কথা থাকলেও শতবর্ষব্যাপী নারীশিক্ষা আন্দোলনের স্মারক হিসেবে ইডেন ও বদরুন্নেসার একাডেমিক ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে বলে শিক্ষকদের আশঙ্কা।
তারা বলেন, ‘যদি বর্তমানে কর্মরত শিক্ষকদের প্রত্যাশা প্রতিফলিত না হয়, তাহলে সেবার মান হ্রাস পাবে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটি বহুমাত্রিক সমস্যার মধ্যে রয়ে গেছে।’
শিক্ষকেরা আরও বলেন, ‘সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থায়ী ক্যাম্পাস ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছাড়াই বছর পার করছে, যার ফলে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে।’
শিক্ষকরা কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলেন, সাত কলেজের বিদ্যমান অবকাঠামো ও মানবসম্পদ কাজে লাগিয়ে কলেজিয়েট বা অধিভুক্ত কাঠামোতে পরিচালনার ব্যবস্থা করা হোক। প্রশাসন থেকে পাঠদান পর্যন্ত দায়িত্বে থাকুক শিক্ষা ক্যাডার। পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণা বাজেট, ল্যাব ও লাইব্রেরি সুবিধা বৃদ্ধি, আবাসন সংকট নিরসন ও বৃত্তি সুবিধা নিশ্চিত করে গুণগত উচ্চশিক্ষা বজায় রাখতে হবে।
মানববন্ধনে সাত কলেজের শিক্ষক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের নেতা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তারা অংশ নেন।