লন্ডনে কবি নাজমুল হক নাজুকে নিয়ে কবিকণ্ঠের ব্যতিক্রমী সাহিত্যালাপ

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৪:২২ অপরাহ্ণ

লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কবি নাজমুল হক নাজুকে নিয়ে অন্তরঙ্গ আলাপ। গেল ২১ সেপ্টেম্বর  সন্ধ্যায় পূর্ব লন্ডনে সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসে এ আলাপে উঠে  আসে নব্বই দশকে সিলেটে এক ঝাঁক প্রতিবাদী কবিদের আর্বিভাবের কথা। অতীতের অনেক কিছুকে অস্বীকার করে সাহসী কথা বলার মাধ্যমে নতুন স্বর সৃষ্টি করার প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ ছিল তখনকার সময়ে বিস্ময়কর।  সম্প্রতি কবি প্রকাশক ও ঘাস লিটলম্যাগ সম্পাদক কবি নাজমুল হক নাজু বিলাত সফরে এলে কবিকণ্ঠ সাহিত্য সংগঠন আয়োজন করে এ ব্যতিক্রমী সাহিত্যালাপ। বিশিষ্টজন হাবিব রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে যোগ দেন লিডস থেকে আগত কবি টি. এম. কায়সার। লন্ডনের কবি ও সাহিত্যসেবীদের মধ্যে অংশ নেন মতিয়ার চৌধুরী, সৈয়দ এনামুল ইসলাম, ময়নূর রহমান বাবুল, শাহ শামীম আহমেদ, শাহাব আহমদ বাচ্চু, নাজনীন সুলতানা শিখা,ফারুক আহমদ, হামিদ মোহাম্মদ, নোমান আহমদ, ফয়েজুর রহমান ফয়েজ, জামাল আহমেদ খানসহ আরো অনেকে। কবি টি. এম. কায়সারের সঞ্চালনায় স্মৃতিচারণ আর নব্বই দশকের উন্মাতাল সময়ে সিলেটে এক ঝাঁক তরুণ কবি নাজমুল হক নাজুর মাহমুদ কম্পিউটারকে ঘিরে যে সাহিত্য চর্চা গড়ে ওঠে, তর্কবিতর্ক আর সৃজন বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ রাত কাবাড় করা হুলস্থূল,পায়ে হেঁটে সিলেট শহর তচনছ করার বেপরোয়া দিন নিয়ে আলেোচনা করেন উপস্থিতজন। এই  স্বপ্নবান তরুণদের মধ্যে টি এম কায়সার রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে বসেন এসব আড্ডায়। ঢাকা, কলকাতার তরুণ কবি লেখকরাও সিলেটের তরুণদের এসব বিস্ময়কর নতুন ভাবনাকে নিয়ে আলোকপাত করতেন সময়ে সময়ে। এই তরুণদের মধ্যে নাম উঠে আসে মোস্তাক আহমাদ দীন, মাহবুব লীলেন, কবি জফির সেতু, টি এম কায়সার, শামীম শাহান, আহমেদ মিনহাজ, শাহ শামীম আহমেদ, ফজলুররহমান বাবুলসহ আরো অনেকের কথা। তাদের চিন্তাধারার পাশে থাকতেন, উৎসাহ দিতেন কবি শুভেন্দু ইমাম,কবি হামিদ মোহাম্মদসহ অগ্রজরাও। তারা বের করতেন লিটন ম্যাগ গ্রন্থী, হুদি, চোখসহ আরো অনেক অনেক প্রকাশনা।

কবি শামীম আহমেদ বলেন, সারাদিন বা রাত আড্ডা হতো, ঝড়ের মতো আসতাম, যেতাম, তর্কে জড়িয়ে পড়াই ছিল আমাদের টান। এছাড়া আমরা ক্ষুধার্ত কবিদের খাওয়ারও আশ্রয় ছিল মাহমুদ কম্পিউটার। আমরা কেউবা ছাত্র, কেউ বেকার যুবক,পকেট শুন্য, ঘুরতাম সারা শহর। খাওয়ার জন্য ছুটে আসতাম মাহমুদ কম্পিউটারে। কেননা, নাজু ছিল আমাদের মাঝে অল্প বয়সে ব্যবসায়ী। সুতরাং উদরের ক্ষুধার জ্বালাও নিবারণ হতো মাহমুদ কম্পিউটারে এসে। নাজু ছিল এব্যাপারে উদার। তিনি বলেন, সবচয়ে মজার ব্যপার হলো, টি. এম. কায়সারের ওপর অনেকেই ক্ষ্যাপা থাকতেন, বলতেন টিএম কায়সার রবীন্দ্রনাথকে কবি হিসেবে অস্বীকার করেন, তিনি কী পাইছেন, তিনি কি টি টিএস্ ইলিয়ট? ইলিয়টও তো রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করেননি। আমরা ছিলাম সেই ঝড়ের দিনের এক ঝাঁক কবিতা পাগল যুবক, প্রতিবাদী, অতিমাত্রায় বেহিসাবী।

সৈয়দ এনাম বলেন, আমরা কয়েকজন মিলে সমসাময়িক সময়ে সৃজনশীল গ্রন্থ বিপনন প্রতিষ্ঠান ‘বইপত্র’ চালু করি। কবি শুভেন্দু ইমাম. আফতাব হোসেইন ও আমি এটি শুরু করি একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে। মান সম্মত বইয়ের দোকান হিসাবে বইপত্র’ এমনই ছিল, হুমায়ূন আহমেদেরও বই আমরা বিক্রি করতাম না। এমন চ্যালেঞ্জ আমার মনে হয় বাংলাদেশ কেন কলকাতায়ও কেউ নিতে সাহস করেনি।নাজুও সর্ব প্রথম সিলেটে কম্পিউটার নিয়ে প্রিন্টিং ব্যবসায় নামেন। এটাও চ্যালেঞ্জ ছিল। এখন তার মাহমুদ কম্পিউটার কনিষ্টভাই চালান, তিনি ছাপাকানন নামে বিশাল আরেকটি প্রেস চালান, ঘাস প্রকাশনী পরিচালনা তো আছেই, সঙ্গে সাহিত্যান্দোলন ও ঘাস লিটল ম্যাগ প্রকাশনা চালিয়ে যাচ্ছেন আরো ব্যাপকভবে। তার সৃজন যাত্রা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। হামিদ মোহাম্মদ বলেন, আমি নব্ব্ইয়ের গোড়ার দিকে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে গিয়ে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ি। সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে কিছুটা অনুপস্থিত। এক সময়ে বুঝতে পারলাম সিলেটে সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে অনেক কিছু হচ্ছে, কিন্ত আমি বাদ পড়ে যাচ্ছি। ফিরতে গিয়ে প্রথমে কবিতার বই বের করার মনস্থ করি। অতীতে যা লিখেছি, কিন্তু লেখার কপি হাতে নেই। আমি লন্ডনে থাকাকালীন আমার শিশু সন্তানরা ওসব বিক্রি করে চানাচুর খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু বন্ধুবান্ধবরা হতাশ হতে দেননি। তারা পুরোনো নানা ম্যাগাজিন, পত্র-পত্রিকা খুঁজে খুঁজে আমার অনেক কবিতা ও গল্প সংগ্রহ করে দিলেন। প্রথমে কবিতার বই ‘স্বপ্নের লাল ঘুড়ি’ ‘শিকড়’ থেকে বের করি কবি মোস্তাক আহমাদ দীন এর সহযোগিতায়। এরপরই নাজমুল হক নাজু ছেপে দেন উপন্যাস ‘কালোদানব’ ও গল্পের বই ‘হৃদয়ে রঙধনু’।‘শিকড়’ থেকেই প্রকাশিত হয়। এই পথ চলা শুরু। আজকের হামিদ মোহাম্মদের বিলাতের মাটিতে সাহিত্যজগতে চলার পেছনে নাজমুল হক নাজু অকৃত্রিমভাবে জড়িয়ে আছেন। এই গত সপ্তাহে লন্ডনে আসার সংবাদ দিয়ে ‘পান্ডুলিপি দেন, বই ছেপে নিয়ে আসবো।’ এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন উপন্যাস ‘পরিবানু’ ছেপে কপি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন নাজু। তার এমন অবিশ্বাস্য দায়িত্বশীলতায় অবাক না হয়ে কি পারা যায়? মতিয়ার চৌধুরী সিলেটে যুবক বয়সে আশির দশকে সাহিত্য চর্চায় জড়াতে গিয়ে বললেন, আমি গ্রামে থাকতাম, নবীগঞ্জে। যুগভেরীকে কেন্দ্র করে সাহিত্য আড্ডা থাকলেও মফস্বলে থাকায় আড্ডায় যোগ দেওয়ার সুযোগ কম ছিল। লেখা নিয়ে আসতাম যুগভেরীতে ছাপতে। ডাকে যুগভেরী নিতাম। লেখা ছাপা হলে আনন্দ কে দেখে। বিলাত চলে এলেও মন পড়ে থাকতো সিলেটে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নব্বইয়ে আপনাদের আড্ডার বিবরণ শুনে সত্যিই ভালো লাগছে। কবি ময়নূর রহমান বাবুল বলেন, আপনাদের মাহমুদ কম্পিউাটরের আড্ডার সময় আমি বিলাতবাসী হয়ে গেছি। সেই আড্ডার সদস্যদের সাথে লন্ডনে যারা আমার মতো পরবতীতে এসেছেন, তাদের সাথে, যেমন কায়সারসহ অন্যদের কাছে গল্প শুনেছি। আজকে আরো বিস্তৃত শুনে ভালো লাগলো। কথা বলেন, নোমান আহমেদ। তিনি বই প্রকাশ ও বিপনন নিয়ে প্রশ্ন করেন প্রকাশক হিসাবে নাজুর কাছে। বিপনন নিয়ে নাজু প্রকাশকদের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে বলেন, সিলেটে শুধু নয়, বাংলাদেশে বই বিপনন সংস্কৃ্তিটা তেমন লেখকবান্ধব হয়ে ওঠেনি, আসলে-সংস্কৃতিটা্ নেই-ই বলতে পারেন। কয়েকটি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তিনি। সব শেষে সভাপতি হাবিব রহমান বলেন, আমি মনোযোগ দিয়ে সকলের কথা শুনলাম। শুনতে শুনতে মনে হলো, সৃজন মানেই বিক্ষুদ্ধ হওয়া, প্রতিবাদী হওয়া। আমাদের সময়ে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন ছাত্র ইউনিয়নের মাঝেই ছিল সাহিত্যচর্চার চলটা বেশি। আমি তাদের সংকলন প্রকাশে সহাযতা করতাম। দেখেছি, তাদের চোখেমুখে সৃজন তৃষ্ণা কত মায়ময়। আজকের আড্ডায় আমি আরো সমৃদ্ধ হলাম।

নাজমুল হক নাজু নব্বই দশকের সিলেটের ষোলজন কবি ও সাহিত্যিকের বর্তমান ভাবনা কেমন, এই কৌতুহল থেকে তাদের সাক্ষাতকার নিয়ে সম্প্রতি একটি বই ‘সংলাপ, সংরাগে’ প্রকাশ করেছেন। বইটির কপি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, এতে নব্বই দশকে যে চিন্তা  চেতনা নিয়ে এসব লেখকদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেটা আজও তাদের মাঝে সদর্পে আছে, বদলায়নি-একটুও-এমন কথার প্রতিধ্বনি সমৃদ্ধ গ্রন্থখানায় রয়েছে। এই ব্যতিক্রমী সংকলনটি এক ঐতিহাসিক বাক বদলের অসম্ভব স্বাক্ষর হিসাবে গণ্য করার দাবী রাখে মন্তব্য করেন উপস্থিত সুধীজন। এই প্রসঙ্গ ছাড়াও মাহমুদ কম্পিউটার কেন্দ্রিক আড্ডা সম্পর্কে নাজমুল হক নাজু আলোচনায় বলেন, বড় কিছু করেছি, এমন ভাবনা আমার মাঝে নেই। আমি বন্ধুপাগল মানুষ। মাহমুদ কম্পিউটার ছিল আমার সেই বন্ধুসৃষ্টির অভয়ারণ্য। বন্ধুত্বের বন্ধনের সুঁতোর টান কত যে গভীর, আমি টের পাচ্ছি লন্ডনে এসে। ভাবিনি, এতো সহজে এখানে সবাইকে পেয়ে যাবো, আবার জমজমাট আড্ডাও দেবো।এ ক্ষেত্রে আমি আমাকে খুব সৌভা্গ্যবানই মনে করছি। মাহমুদ কম্পিউটার-এর মালিক কবি নাজমুল হক নাজু হলেও অনেকেই জানতো না কে মালিক। মূল চেয়ার দখল করে বসতেন এই সব আড্ডার কবিরা। অনেকের ঠিকানাই ছিল পূর্ব জিন্দাবাজারের মাহমুদ কম্পিউটার। এসব বলেন আলোচকরা।

পত্রিকা অফিসের আড্ডাশেষে অদূরেই সাংবাদিক আ .স. ম মাসুমের মোবাইল পিজা‘য় দ্বিতীয় দফা আড্ডা্ চলে আরো কিছুক্ষণ। গরম গরম পিজা খেতে খেতে চলে আবৃত্তি, স্বরচিত কবিতা পাঠ। প্রথমেই কবি শাহ শামীম আহমেদ তার প্রিয় কবিতা বোধ আবৃত্তি করেন। শাহ শামীম না-থেমেই আবৃত্তি করেন ‘সিলেট শহর কবিতার খাতা’ কবিতাসহ আরো কয়েকটি। কবি শামসুর রাহমানের তিরোধানে লেখা কবিতাটির একটি অংশ আবৃত্তি করেন। কবি শাহ শামীম রাজনীতিতে পুরো জড়িয়ে গেলেও কবিতায় তার বিচরণ অপুর্ব। যে কবিতাগুলো আবৃত্তি করলেন, সবই তার ঠোঁটস্থ। এরপর কবি হামিদ মোহাম্মদ তার সদ্য প্রকাশিত প্রেমের কবিতা গ্রন্থ থেকে প্রিয় কবিতা আহাজারি’ ‘ভালোবাসা পাঠ করেন। কবি ফযেজুর রহমান ফয়েজ কৈশেোর স্মৃতি ও সাহিত্যচর্চার হাতে খড়ি, শাহ শামীম ও নাজু সান্নিধ্য ও সৃজনশীল হয়ে ওঠার গল্প বললেন। নাজনীন সুলতানা শিখা তন্ময় হয়ে এসব শুনে তারণ্যের আমেজে বিভোর হয়ে পড়েন। ফাঁকে ফাঁকে চলে কবি নাজমুল হক নাজুর সিলেটের সাহিত্য চর্চা নিয়ে মেঘমেদুর উচ্চারণ আর কবিতা পাঠ। নোমান আহমেদ ছিলেন এই বৈঠকেও প্রখর পর্যালোচক ও নিষ্টাবান শ্রোতা।  উল্লেখ্য,দুটি আসরেই সঙ্গে ছিলেন বিলাত সফরে আসা কবি নাজমুল হক নাজুর সহধর্মিণী ও পুত্র। তারাও উত্তর দেন নানা কৌতুহলী প্রশ্নের।

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

Developed by: Web Design & IT Company in Bangladesh