সব
স্বদেশ বিদেশ ডট কম
চলতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হারে ধস নেমেছে। যা গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম পাসের হারে রেকর্ড।
এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর চেয়ে কম পাসের হার ছিল ২০০৪ সালে। ওই বছর এইচএসসিতে পাস করেছিলেন ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। ২০০৫ সালে পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। এরপর এইচএসসিতে পাসের হার আর কখনো এর চেয়ে নিচে নামেনি। সেই হিসাবে গত ২১ বছরের মধ্যে এবারই পাসের হার সবচেয়ে কম।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
ফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ বছর ফেল করেছেন ৪১ দশমিক ১৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন, যা গত বছরের চেয়ে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন কম।
দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করেননি। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের পাসের হার শূন্য। গত বছর শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৬৫টি। আবার শতভাগ পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে এক হাজার ৪৩টি। সার্বিক দিক বিবেচনায় এবার ভয়াবহ ফল বিপর্যয় ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ২০০২ সাল পর্যন্ত ডিভিশন পদ্ধতি অর্থাৎ, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ছিল। ২০০৩ সাল থেকে জিপিএ পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ করা হয়, যেখানে পাঁচটি স্কেলে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়। নতুন এ পদ্ধতি চালুর পর শিক্ষার্থীদের বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগে।
জিপিএ পদ্ধতি চালুর প্রভাব পড়ে ২০০৩ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে। সে বছর পাসের হার ছিল ৩৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০০৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশে। এরপর থেকে পাসের হার ক্রমেই বাড়তে থাকে।
২০০৫ সালে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাস করেছিলেন ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া ২০০৬ সালে পাসের হার ছিল ৬৫ দশমিক ৬৫, ২০০৭ সালে ৬৫ দশমিক ৬০, ২০০৮ সালে ৭৬ দশমিক ১৯, ২০০৯ সালে ৭২ দশমিক ৭৮, ২০১০ সালে ৭৪ দশমিক ২৮, ২০১১ সালে ৭৫ দশমিক ০৮, ২০১২ সালে ৭৮ দশমিক ৬৭, ২০১৩ সালে ৭৪ দশমিক ৩০, ২০১৫ সালে ৬৯ দশমিক ৬০ শতাংশ।
এরপর ২০১৬ সালে পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৬৮ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ২০১৯ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে সে বছর ফরম পূরণ করা সব শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দেওয়া হয়, যেটিকে অটোপাস বলা হয়। অর্থাৎ, ২০২০ সালে পাসের হার হয় ১০০ শতাংশ।
করোনার কারণে এরপর কয়েক বছর কখনো সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে, কখনো চার বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষা হয়। সে বছর পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ, ২০২২ সালে ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
সবশেষ ২০২৪ সালে পূর্ণ নম্বর, পূর্ণ সিলেবাস ও পূর্ণ সময়ে ফেরে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা। তবে কয়েকটি পরীক্ষা হওয়ার পর শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। এতে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। এ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সরকার পরিবর্তনের পর আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দাবি করে পরীক্ষা আর না নেওয়ার জন্য শুরু হয় আন্দোলন। তাতে বাধ্য হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাতিল করে। ওই বিষয়গুলোর পরীক্ষা না নিয়ে এসএসসির ফলাফল বিবেচনা করে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ে ফল প্রকাশ করা হয়। এতে পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
পাঁচ বছর পর এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে। এজন্য ফলাফল নিম্নমুখী বলে মনে করেন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে অতিরঞ্জিত ফল এড়াতে গ্রেস মার্কস (বাড়তি নম্বর) দেওয়া পরিহার করার নীতি অবলম্বনে শিক্ষার্থীদের ফল খারাপ হয়েছে বলেও মনে করেন তারা।
১১টি শিক্ষা বোর্ডর মোর্চা বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, এবার আমরা স্বাভাবিক পরীক্ষার ধারায় ফিরেছি। পূর্ণ সিলেবাস, পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ের ওপর পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এতে হয়তো শিক্ষার্থীরা মানিয়ে নিতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, দেখুন, আমরা কিন্তু চাই না একজন পরীক্ষার্থীও ফেল করুক। তবে শিক্ষার মান যে তলানিতে নেমেছে; অতিরঞ্জিত যে ফলাফল বিগত বছরগুলোতে দেখানো হয়েছিল, তাতে ক্ষতি হয়ে গেছে। সেখান থেকে ফিরে আসতে তো হবে। এটা করতে গেলে কোথাও না কোথাও আপনাকে থামতেই হবে।
তবে বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, স্বাভাবিক ধারায় পরীক্ষা ফিরলেও স্বাভাবিক প্রস্তুতি কেন শিক্ষার্থীদের নেওয়া সম্ভব হয়নি, সেই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজতে হবে। আমি পরীক্ষার সিলেবাস, প্রশ্নপত্র, নম্বর দেওয়ার ধরন আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিচ্ছি, তাহলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পাঠদানের ধরনেও তো সেই স্বাভাবিক ধারা আনতে হবে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, সেটা করা হয়নি। সেখানে গলদ রয়েছে।
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা কাউকে কোনো ছক বেঁধে দিইনি বা নির্দিষ্ট করে দিইনি যে এইভাবে নম্বর ছাড় দেবেন অথবা ওভারমার্কিং (যা প্রাপ্য নয়, তার চেয়ে বেশি নম্বর দেওয়া) করবেন, বেশি বেশি দিয়ে পাসের হার বাড়াতে হবে, এ রকম কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’ তিনি বলেন, ‘গত এসএসসি পরীক্ষার সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলে দেওয়া হয়েছে নিয়ম মোতাবেক চলবে। বোর্ড পরীক্ষকদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের নিয়মটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সঠিক মূল্যায়নের জন্য এবার সময়ও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
প্রায় অর্ধেক পরীক্ষার্থী পাস করতে পারেননি, আবার গ্রাম-শহরের ফলাফলেও ব্যাপক তারতম্য দেখা যাচ্ছে। সেটা কি দেশের শিক্ষায় যে বড় কোনো গলদের কথা বলা হয়, সেটিই এই ফলাফলে…? জবাবে অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, এই যে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাস করল না, এটা তো কাঙ্ক্ষিত নয়। এই বিষয়টিতে আমরা একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি। তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, গলদ আছে, অবশ্যই গলদ আছে। সেই গলদের জায়গাগুলো ঠিক করতে হবে। সেই দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, সেই দায়িত্ব বোর্ডের, সেই দায়িত্ব সবার।