ঘরে ঘরে ডেঙ্গুজ্বর

সালাহ উদ্দিন বাবর,

  • প্রকাশিত: ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১:০০ অপরাহ্ণ

রাজধানীর মিরপুরের কালশীর বাসিন্দা হামিম হোসেনের ছোট ছেলে মাহফুজ ৭ দিন ধরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি। আদমজী ক্যান্টমেন্ট স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এ শিক্ষার্থী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি। আক্রান্ত হওয়ার দিন থেকে পরিশ্রম করছেন ছেলের সুস্থতার জন্য হামিম হোসেন। তিনি বলেন, ‘মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়। মশা মারতে না পারলে সিটি করপোরেশনকে কেন আমরা টাকা দেব? মশা মারার কাজ তো তাদেরই।’

একই অবস্থা কালশীর একটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষিকা রুমানা বেগমের সন্তানের। রুমানা বেগম বলেন, ‘আমাদের এলাকায় মশকনিধনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। যদি মশকনিধন হতো, তাহলে ঘরে ঘরে ডেঙ্গু হতো না। দুয়েক জায়গায় মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা গেলেও তা একেবারেই অপ্রতুল। এ ব্যবস্থার জোরদার না করলে সামনের অবস্থা আরো ভয়াবহ হতে পারে।

শুধু মিরপুরের কালশীই নয়, রাজধানীজুড়েই প্রতিদিন শত শত ডেঙ্গু রোগী নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করছেন স্বজনরা। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্র বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশিরভাগই ঢাকার বাসিন্দা। জানা গেছে, গতবারের মতো এবারও ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুতই অবনতির দিকে যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিনই। অনেক রোগী বাসায় ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছেন, ফলে তাদের তথ্য উঠে আসছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু বুলেটিনে।

এডিস মশার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের প্রচেষ্টা চলমান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানি জমতে না দেওয়া, মশার ওষুধ ছিটানো সবই চলছে। জনসাধারণকে সচেতন করতে এরই মধ্যে তরুণদের দিয়ে কর্মসূচি করছি। মশার জন্ম ও বংশবিস্তার ঠেকাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মনিটরিং করতে ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে নামিয়ে দিয়েছি। আমরা আমাদের পদক্ষেপের সুফলও পাচ্ছি। আপনি দেখে থাকবেন, আমাদের শহরে রোগীর সংখ্যা কম।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধের কাজ সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের। তারা করছে। আমাদের কাজ আক্রান্তদের সেবা দেওয়া। আমরা সেটা আন্তরিকতার সঙ্গে করছি। বড় সমস্যা হলো, রোগীরা অনেক দেরি করে হাসপাতালে আসেন। তখন জটিলতা বেড়ে যায় ও চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা করাতে হবে এবং প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সময়মতো চিকিৎসা নিলে মৃত্যু হার কমানো সম্ভব।’

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো ৬৫৯ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যু হয়নি। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২৫৯ জনের। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৬৪ হাজার ২৯৭ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে ১ হাজার ৭৭৩, জুনে ৫ হাজার ৯৫১, জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪, আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬, সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার ৮৬৬ এবং চলতি মাসের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ হাজার ২৯৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশকনিধনের বিকল্প নেই। তবে আক্রান্ত হয়ে গেলে ডেঙ্গু পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শে চলা প্রয়োজন। দরকার হলে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হবে। কারণ ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বেশিরভাগই দেরিতে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে হয়েছে। এ বিষয়ে ডা. তৌফিক হাসান বলেন, মশকনিধনের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধ এককভাবে সরকারের কাজ নয়। এজন্য জনগণকে সচেতন হতে হবে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এপিডেমিওলজিস্ট তারেক হাসান শিমুল বলেন, ডেঙ্গু মশা কামড়ালে হয়। পানি জমলে মশা জন্মায়- এসব আমরা জানি তবু কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। প্রথমত, ভাইরাসের নতুন নতুন ধরন তৈরি হচ্ছে, যা প্রতি বছর সংক্রমণের মাত্রা ও জটিলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমরা নিজেরা যথেষ্ট সচেতন নই। আমাদের ঘরবাড়ির ফুলের টবে বা ছাদের পানির ট্যাংকে; এমনকি শহরের ড্রেনে, রাস্তায়, ছাদে যেখানেই পরিষ্কার পানি জমে, সেখানেই মশা জন্ম নিচ্ছে। অনেক সময় উচ্চশিক্ষিত, পেশাদার মানুষের ঘরেও দেখা যায় টবে বা ফুলের পাত্রে মশার লার্ভা রয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা একদিকে সরকারকে ব্যর্থ বলি, অন্যদিকে নিজের দায়িত্বটা পালন করি না। আসলে সরকারের প্রচেষ্টা তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন প্রত্যেক মানুষ নিজের ঘর, বারান্দা, ছাদ ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখবে। যেকোনো পাত্রে তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকা মানেই সেটি মশার প্রজননস্থল। তাই এটি নিয়মিত পরিষ্কার করা জরুরি। মশার সংখ্যা বাড়লে ডেঙ্গু কমার সুযোগ নেই। আমরা যেন নিজেরাই মশার চাষ করছি, এটি বন্ধ না করলে কোনো ওষুধ বা স্প্রে দিয়েও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, সম্প্রতি বরগুনা এলাকায় গিয়ে দেখি, প্রতিটি ঘরেই বৃষ্টির পানি ড্রামে ধরে রাখা হয়, কারণ সেখানে টিউবওয়েল বা সুপেয় পানির ঘাটতি আছে। কিন্তু সেই ড্রামগুলোই মশার জন্মস্থান হয়ে গেছে। যদিও ঢাকনা দেওয়া থাকে, তবু পানি তোলার সময় খোলা হয়। ফলে মশা ঢুকে বংশবিস্তার করে। আমরা যখন টর্চলাইট দিয়ে দেখি, আসলেই সেখানে লার্ভা ভাসছে। এ অবস্থা পরিবর্তন না করলে ডেঙ্গু কখনো কমবে না। সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটি শুধু সরকারের একার লড়াই নয়। জনগণকে সম্পৃক্ত হতে হবে। মশার আবাস ধ্বংস করা, পানি জমে থাকা বন্ধ করা এবং নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাই এখন সবচেয়ে বড় প্রতিরোধমূলক অস্ত্র। সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। মশা নিধন না করলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি আরো ভয়াবহ হবে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণই এখন সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

Developed by: Web Design & IT Company in Bangladesh