সব
স্বদেশ বিদেশ ডট কম
মারুফ হাসান ::
ফুটপাত দখলমুক্ত করার অভিযান নতুন কিছু নয়। সিলেটসহ দেশের প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই বারবার এমন অভিযান চালানো হয়। উচ্ছেদের পর দু’একদিন ফুটপাত খালি থাকে, তারপর আবার পুরনো চিত্র ফিরে আসে। এর কারণ একটাই—শুধু জোর করে উচ্ছেদ করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। সমস্যার মূলে রয়েছে নগরবাসীর নিজস্ব ক্রয়াচরণ, প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক ছত্রছায়া এবং হকারদের জীবন-জীবিকার টান ।
সস্তা, কাছে পাওয়া, দরদাম—এই সুবিধাগুলো নাগরিকদের ফুটপাতের দিকে টানে। এখানে আসল সত্যিটা হলো—যতদিন পর্যন্ত নাগরিকরা ফুটপাত থেকে কেনাকাটা করবে, ততদিন পর্যন্ত হকাররা বারবার ফিরে আসবে। তাই সমাধানের প্রথম ধাপ হওয়া উচিত নাগরিকদের আচরণ পরিবর্তন। প্রশাসনকে প্রচারণায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে এই বার্তায়: “আপনারা ফুটপাত থেকে কেনাকাটা বন্ধ করুন, তাহলেই হকাররা ক্রেতা হারাবে, হারাবে ফুটপাতে বসার আগ্রহ।”
সিলেটের সাম্প্রতিক অভিযান: পরিসংখ্যান কী বলে
সম্প্রতি সিলেট সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন যৌথভাবে একাধিক উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কয়েকশ হকার সরিয়ে দেয়া হয়েছে, বিপুল সংখ্যক ভ্যানগাড়ি ও অস্থায়ী কাঠামো ভাঙা হয়েছে। কিন্তু ৭২ ঘণ্টা না যেতেই দেখা গেছে আবারও অনেক জায়গায় হকাররা বসে পড়েছে। সিটি করপোরেশনের জরিপে দেখা যায়, নগরের ব্যস্ততম ২০টির বেশি পয়েন্টে প্রতিদিন গড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার হকার ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছে। অর্থাৎ, সমস্যা সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে আসলেও তা কখনো স্থায়ী হয়নি।
সমস্যার মূল আরও গভীরে :
১. নাগরিক চাহিদা: সস্তা ও সহজলভ্য জিনিস কেনার প্রবণতা থেকে মানুষ ফুটপাতের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ক্রেতা থাকলেই বিক্রেতা থাকবে—এটাই সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা।
২. প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা: ফুটপাত ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোনো নগর পরিকল্পনা নেই। আইনগত স্বীকৃতি, টাউন ভেন্ডিং কমিটি বা নিয়মিত জরিপ না থাকায় প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলো একতরফা ও অস্থায়ী হয়ে থাকে।
৩. রাজনৈতিক ছত্রছায়া: সবচেয়ে বড় বাধা হলো রাজনীতি। স্থানীয় রাজনীতিবিদরা ভোটব্যাংক ধরে রাখতে হকারদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। ফলে প্রশাসন অভিযান চালালেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
৪. অর্থনৈতিক বাস্তবতা: অধিকাংশ হকার নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের বিকল্প জীবিকা নেই। বাজারে দোকান ভাড়া বা লাইসেন্স ফি দেওয়ার সামর্থ্যও নেই। ফলে জীবিকা বাঁচাতে তারা আবার ফুটপাতে ফিরে আসে।
কেন সমাধান বারবার ব্যর্থ হয়?
বিশ্বের বিভিন্ন শহরের অভিজ্ঞতা বলে, শুধু উচ্ছেদ-নির্ভর কৌশল ব্যর্থ হয়। বিকল্প ব্যবস্থা না দিলে হকাররা বারবার ফিরে আসে। ভারতের স্ট্রিট ভেন্ডরস অ্যাক্ট ২০১৪ উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, যেখানে হকারদের আইনি স্বীকৃতি দিয়ে নির্দিষ্ট ভেন্ডিং জোনে তাদের স্থানান্তর করা হয়েছে। আমাদের দেশে এখনো তেমন কোনো আইনি কাঠামো আছে বলে আমার জানা নাই।
টেকসই সমাধানের পথ:
প্রথম ধাপ, ক্ষুদ্রকালীন বা ০ থেকে ৩ মাসের মধ্যে কিছু জরুরি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে থাকবে একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠন, যেখানে সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ এবং হকার প্রতিনিধিরা থাকবেন। তাদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে বোঝানো হবে। একই সময়ে একটি বিস্তৃত জরিপ চালানো দরকার, যাতে প্রতিটি হকারের নাম, ঠিকানা, কী পণ্য বিক্রি করছেন এবং তাদের আয়ের উৎসের তথ্য রেকর্ড করা হয়। পাশাপাশি নাগরিকদের উদ্দেশে সচেতনতা ক্যাম্পেইন চালানো জরুরি—স্পষ্ট বার্তা হবে “ফুটপাত থেকে কেনাকাটা বন্ধ করুন।” এই প্রচারণা যাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, রেডিও, টিভি, মসজিদ-মাদ্রাসা এবং স্কুল-কলেজের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় ধাপ, মধ্যমেয়াদি বা ৩ থেকে ১২ মাসের মধ্যে আরও কিছু কাঠামোগত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। একটি টাউন ভেন্ডিং কমিটি (TVC) গঠন করা, যারা নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করবে এবং ভেন্ডিং জোন চিহ্নিত করবে। এরপর ভেন্ডারদের নিবন্ধন ও সার্টিফিকেশন দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ —ছোট ফি বা আইডি কার্ডের মাধ্যমে একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা তৈরি করা। ব্যস্ত কয়েকটি এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত ভেন্ডিং জোন চালু করা, যেখানে স্টলের মানদণ্ড, সময়সীমা ও পরিচ্ছন্নতা পর্যবেক্ষণ করা হবে। পাশাপাশি কিছু হকারের জন্য অর্থনৈতিক বিকল্পও তৈরি করা দরকার—মাইক্রো-ক্রেডিট ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে ভিন্ন পেশায় টিকে থাকার কার্যত ব্যবস্থা দেওয়া যেতে পারে।
তৃতীয় ধাপ, দীর্ঘমেয়াদি বা ১২ থেকে ৩৬ মাসের মধ্যে নগর পরিকল্পনায় সংস্কার আনা দরকার। সর্বপ্রথম, নাগরিকদের আচরণ পরিবর্তনে উৎসাহিত করতে কিছু প্রণোদনা চালু করা যেতে পারে, যেমন ‘ফুটপাত মুক্ত সপ্তাহ’ আয়োজন করা বা দোকানদারদের বিশেষ সনদ প্রদান করা। এছাড়াও ফুটপাত প্রশস্ত করা, স্থায়ী ভেন্ডিং জোন তৈরি এবং স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করা। এ সময় একটি আইনি কাঠামোও গড়ে তোলা জরুরি—স্থানীয়ভাবে প্রযোজ্য স্ট্রিট ভেন্ডার্স নীতি, যেখানে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা থাকবে। এগুলো শহরকে আরও টেকসই এবং সুশৃঙ্খল করার পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
রাজনীতির ভূমিকা :
হকার সমস্যার সবচেয়ে জটিল দিক হলো রাজনীতি। হকাররা রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থেকে ফুটপাত দখল করে রাখে। নির্বাচনের সময় তারা মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেয়, বিনিময়ে দখলদারির সুযোগ পায়। এ চক্র ভাঙা ছাড়া কোনো উদ্যোগ সফল হবে না। রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে—এটি শুধু প্রশাসনিক নয়, সামাজিক সমস্যা। ভোট নয়, নগরবাসীর স্বার্থই হওয়া উচিত অগ্রাধিকার।
নাগরিকদের প্রতি আহ্বান :
সমাধানের মূল চাবিকাঠি নাগরিকদের হাতেই। যদি নগরবাসী সচেতনভাবে ফুটপাত থেকে কেনাকাটা বন্ধ করে, তবে হকাররা ধীরে ধীরে বসতে নিরুৎসাহিত হবে। মনে রাখতে হবে, চাহিদা থাকলেই সরবরাহ টিকে থাকে।
ফুটপাত শুধু ব্যবসার জায়গা নয়, এটি মানুষের চলাচলের পথ। শিশু, নারী ও বয়স্কদের নিরাপদ চলাচলের জন্য ফুটপাত মুক্ত রাখা জরুরি। তাই সমাধান শুধু উচ্ছেদ নয়; নাগরিক সচেতনতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পরিকল্পিত উদ্যোগের সমন্বয়ে আসতে পারে স্থায়ী সমাধান।
প্রশাসনের উচ্ছেদ কার্যক্রম প্রয়োজন, তবে যথেষ্ট নয়। সবচেয়ে জরুরি হলো নাগরিক আচরণে পরিবর্তন। যদি নাগরিকরা ফুটপাত থেকে কেনাকাটা বন্ধ করেন, তবে হকারদের আগ্রহও কমে যাবে।
তাই আজ থেকে স্লোগান হোক: “ফুটপাতে কেনাকাটা বন্ধ করুন, হকারমুক্ত নগরী গড়ুন”
লেখক : স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক জালালাবাদ।