জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে পুড়ছে বিশ্ব

মো. মাঈন উদ্দিন,

  • প্রকাশিত: ২২ জুলাই ২০২২, ৮:৩১ অপরাহ্ণ

গত দু-এক সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশে বিরাজ করছে তীব্র দাবদাহ। অসহ্য গরম। অসহ্য গরমে মানুষসহ প্রাণিকুলে আজ নাভিশ্বাস। দেশের মানুষজন ঘনঘন আকাশপানে তাকাচ্ছে। কখন নামবে স্বস্তির বৃষ্টি। কখন একটু ঠাণ্ডা আবহাওয়া আমাদের গা জুড়াবে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। না বৃষ্টি। না শীতল পরিবেশ। অনেকেই এর কারণ খুঁজছেন। কেন হচ্ছে না বৃষ্টি। স্বস্তির বৃষ্টি। তবে, জানা গেছে, এমন দাবদাহ শুধু বাংলাদেশেই নয়, প্রায় অর্ধেক পৃথিবীজুড়েই বিরাজ করছে তীব্র দাবদাহ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যেন কারখানার বয়লার চেম্বারের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দিনে দিনে। টানা দুই সপ্তাহ ধরে তীব্র দাবদাহ, দাবানল আর খরায় পুড়ছে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি অঞ্চল। আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে ভারত মহাসাগর অবধি আবহাওয়ার ওই অস্বাভাবিক অসহনীয় উষ্ণ আচরণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে প্রাণিজগৎ। বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশে গত দুইদিনে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি ছিল। ১৯৪৮ থেকে ২০২২ সালের আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করলে ৭০ থেকে ৭৪ বছরের ইতিহাসে চলতি জুলাই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র দাবদাহ আর দাবানল। পুড়ছে ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে মরক্কোতেও দাবানলের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। তীব্র দাবদাহে গত এক সপ্তাহে ইউরোপে মৃত্যু হয়েছে ৩৬০ জনের বেশি মানুষের। বিশ্বের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে, বিশ্বের অর্ধেকের বেশি এলাকাজুড়ে এখন তীব্র দাবদাহ বইছে। ইউরোপ থেকে শুরু করে চীন, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াজুড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ ১৫ জুলাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাপপ্রবাহের একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, স্পেনের সেভেলি শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস; ইরানের আহভাজ শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চীনের সাংহাই শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ বড় শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। তীব্র দাবদাহে ব্রিটেনে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে সরকার। তাপ বৃদ্ধির কারণে এবারই প্রথম ব্রিটেনে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে এমন পূর্বাভাসের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে প্রবল বাতাস এবং চরম শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ফ্রান্সের অনেক স্থানীয় বাসিন্দা বিভিন্ন শহর ও গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। গত কয়েক দিনে ১০ হাজারেরও বেশি লোক ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিহঁদ অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফ্রান্স, পর্তুগাল এবং স্পেনের বেশ কয়েক জায়গার দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সেখানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে গেছে। তাপপ্রবাহে পর্তুগাল এবং স্পেনে অন্তত ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। পশ্চিম স্পেনের বেশ কয়েকটি শহরের মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্পেনে অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ তাপমাত্রা ৪৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছেছে। পর্তুগালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গিয়েছে। উত্তরের পিনহাওতে ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এটি পর্তুগালের মূল ভূখণ্ডে জুলাই মাসের জন্য সর্বোচ্চ তাপের রেকর্ড।

এদিকে স্পেনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসকারীরা বলেছেন, তাপমাত্রা কমতে শুরু করবে। আর ফ্রান্সের আবহাওয়া বিভাগ জানায়, গতকাল রবিবার দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকায় সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। গত শনিবার ফ্রান্সের আবহাওয়া বিভাগ ২২টি অঞ্চলে সতর্কতা জারি করে। বার্তা সংস্থা এএফপিকে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক নাগরিক জানান, চলতি বছরের মত দাবদাহের তীব্রতা অতীতে কখনো দেখেননি। ইতালির সরকারও কয়েকটি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ছড়িয়ে পড়া দাবানল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উত্তর মরক্কোতেও একই পরিস্থিতি। সেখানকার বহু প্রদেশে দ্রুত দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় একটি গ্রাম সম্পূর্ণ আগুনে পুড়ে গেছে। আর দাবানলে সেখানে একজন মারা গেছেন। সিএনএনের খবরে বলা হয়, চীনের পূর্বাঞ্চলীয় সাংহাই, নানজিং ও ঝিজিয়াংসহ বেশ কয়েকটি শহরে চলছে প্রচন্ড দাবদাহ। গতকাল বাণিজ্যিক শহর সাংহাইয়ে তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ১৮৭৩ সালের পর শহরটিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এটি। প্রচন্ড গরমে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, ভারতের রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, ওডিশা, ছত্তিশগড় ও অন্ধ্রপ্রদেশের বেশির ভাগ শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠেছে।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, গত কয়েক যুগের মধ্যে ভয়াবহ দাবদাহ ও খরায় পুড়ছে পূর্ব আফ্রিকা। এই খরা গত বছর শুরু হয়ে এখনো চলছে। চার মৌসুম পরও সেখানে বৃষ্টির দেখা নেই। এ অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ চরম অনাহারে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারতীয় মহাসাগরের স্রোতের সঙ্গে সম্পর্কিত বসন্তকালীন বৃষ্টি এ অঞ্চলে পৌঁছানোর আগেই সমুদ্রে ঝরে পড়ছে, যার কারণে বৃষ্টি হচ্ছে না ভূমি অঞ্চলে। ইতালিতে খরার কবলে পড়ে দেশের উত্তরে অবস্থিত ‘পো’ নদীর পাশের পাঁচটি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে ইতালি। বলা হচ্ছে, বিগত ৭০ বছরের মধ্যে এটি দেশটির সবচেয়ে ভয়াবহ খরা। এদিকে বিশ্বের অধিকাংশ সমুদ্রসীমায় আবহাওয়ার ওই অস্বাভাবিক আচরণে এর পাশের এলাকাগুলোতে শুরু হয়েছে তীব্র দাবদাহ। বাংলাদেশেও এর প্রভাব বাড়ছে। শ্রাবণে মেঘের দেখা নেই আকাশে। ভরা শ্রাবণে চলছে খরা। বৃষ্টি-খরায় বিপর্যস্ত মানুষ। তীব্র রোদে হাঁসফাঁস নগর জীবন। রোদের প্রখরতায় থমকে যাচ্ছে জীবনযাত্রা। বর্ষার আকাশে যেন বৈশাখী অনুষঙ্গ। গুমট হয়ে ওঠে পরিবেশ, রাতেও ভ্যাপসা গরম। এমন অবস্থায় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

আবহাওয়াবিদরা বলেন, প্রতি বছরই তিন চারটি তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। তবে এবারের জুলাই মাসের তাপপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী আর অনেক শক্তিশালী। এর প্রভাব পুরো দেশজুড়ে। প্রকৃতিতে বর্ষাকাল চললেও আকাশে যে পুঞ্জিভূত মেঘের অক্ষ সেটা বর্তমানে ভারতের উড়িষ্যা কোস্ট বরাবর পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান করছে। এ কারণে বাংলাদেশে বৃষ্টির দেখা নেই। এই অক্ষ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেলেই মুষলধারে বৃষ্টি সম্ভব বলে জানিয়েছেন। আবহাওয়াবিদগণ বলেন, বৃষ্টি হতে আরো ২-৩ তিনদিন সময় লাগবে। ইতিমধ্যে সিলেটে বৃষ্টি হলেও সেটা স্থানীয় বৃষ্টি। গত ৫ জুলাই থেকে তাপপ্রবাহ চলছে, বৃষ্টির ঘনঘটা কম, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি, আকাশ মেঘমুক্ত একই সাথে প্রখর সূর্যকিরণ। সব মিলিয়ে অসহনীয় অবস্থা। বৃষ্টির জন্য ২০-২১ জুলাই পযন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। ভারী বৃষ্টি ছাড়া গরম কমবে না। দুইদিন পরেও ভারী বৃষ্টিপাত হবে কিনা সেটাও নিশ্চিত না।

কয়েক বছরের তুলনায় এবারের দাবদাহ অনেক তীব্র, অনেক শক্তিশালী। তীব্র এই দাবদাহ থেকে মুক্তি মিলবে ভারি বর্ষণ হলে। কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, এ ধরনের উত্তপ্ত অবস্থা থেকে আপাতত পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। এমন দাবদাহ সাধারণত জুলাইয়ে হয় না। এ বছর ব্যতিক্রম। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে তাপপ্রবাহ দেখা যায়, সেটাই স্বাভাবিক। এই বিশেষজ্ঞ জানান, ১৯ জুলাই রংপুর এবং সিলেট বিভাগে বৃষ্টি হবে। তবে রাজশাহী বিভাগে বৃষ্টির পরিমাণ কম হবে। ২৩ জুলাইয়ের পর আবারও তাপমাত্রা বাড়তে পারে।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর আফ্রিকা থেকে সৃষ্ট তীব্র দাবদাহ ও দাবানলে পুড়ছে ইউরোপের দেশগুলো। মানুষের তৈরি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে দাবদাহ আরো ঘন ঘন, আরো তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠেছে। শিল্প যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে পুথিবীর গড় তাপমাত্রা এরই মধ্যে প্রায় ১ দশমিক ১ সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ। এটি দ্রুত হ্রাস করতে না পারলে তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুটি কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণগুলো বহুল পরিসরে দায়ী। বিধায়, মানবসৃষ্ট কারণগুলো রহিত করা গেলে হয়তো প্রাকৃতিক কারণগুলো প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে এবং আশা করা যায়, প্রকৃতিতে স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খল জলবায়ু ও পরিবেশ ফিরে আসবে। এখন প্রশ্ন হলো, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মানবসৃষ্ট কারণগুলো রহিত করতে বিশ্বের সুশীল সমাজ তথা বিশ্বের ধনী দেশগুলো কতটা আন্তরিক!

লেখক : সেকশন অফিসার, রেজিস্ট্রার দপ্তর

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...