বিশ্বের ৫৩ দেশে তীব্র খাদ্যসংকট

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ৫:১২ অপরাহ্ণ

আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বে তীব্র খাদ্যসংকট বিরাজ করবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৫৩টি দেশের মোট ২২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জন্য জরুরি সহায়তারও প্রয়োজন হতে পারে। এর মধ্যে ‘হাঙ্গার হটস্পট’ বা মারাত্মক ক্ষুধাপীড়িত হিসেবে চিহ্নিত ১৯ দেশের পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।

এমন পরিস্থিতিতে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্যসংকট কমাতে ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। গত মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খাদ্যনিরাপত্তার তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি—উভয় দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আমাদের উদ্যোগ হবে সামগ্রিক।

এফএও এবং ডব্লিউএফপির সদ্য প্রকাশিত অক্টোবর ২২-জানুয়ারি ২৩ (আউটলুক) প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ৪৫ দেশের ২০ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটের মুখে পড়তে পারে, যাদের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হবে। গত বছর পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশসহ ৮টি দেশ ও অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করলে ৫৩ দেশের ২২ কোটি ২০ লাখ মানুষ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এই প্রতিবেদনের সাত বছরে এবারই সর্বোচ্চসংখ্যক দেশ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো।

বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) রিসার্চ ফেলো ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও মজুতের ক্ষেত্রে বড় সংকট হবে না। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্যসহ সব জিনিসের দাম বাড়ায় নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষের জন্য কিছুটা সংকট তৈরি হবে। মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, বড় ধরনের না হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামান্য পুষ্টিহীনতা তৈরি হতে পারে। মুরগির ডিমের দাম বাড়লে স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় টান পড়বে। সে জন্য উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সরবরাহের বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজি বন্ধ, সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে এবং অস্বাভাবিক মুনাফাকারীদের বিরুদ্ধে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ড. ইউনুস বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় আমনের ভরা মৌসুমে পানির অভাবে কৃষকেরা ধান রোপণ করতে পারেননি। ধানের প্রায় ৪২ শতাংশ আসে আমন থেকে। তবে সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে চাষিদের। সব মিলিয়ে আমনের উৎপাদন ঘাটতি ৫-৬ শতাংশ হতে পারে বলে কৃষিবিদেরা ধারণা করছেন। তাহলে বড় কোনো সংকট হবে না। কারণ, সরকার আগেভাগে বিদেশ থেকে চাল কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, আমদানি শুল্কও কমানো হয়েছে। এখন বিশ্ববাজারে আমন চাষের পূর্বাভাস প্রকাশের আগেই চাল কেনা গেলে ভালো। না হলে দাম বেড়ে যেতে পারে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মজুত আছে মোট ১৭ দশমিক ৩৯ লাখ টন। এর মধ্যে চাল ১৫ দশমিক ৭৫ লাখ টন, গম ১ দশমিক ২৭ লাখ টন ও ধান শূন্য দশমিক ৫৬ লাখ টন। সরকার অভ্যন্তরীণভাবে গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান ও চাল মিলে ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৪৭৯ টন বোরো শস্য সংগ্রহ করেছে। আর চলতি অর্থবছরের ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাল ও গম মিলে প্রায় ৪ লাখ ৭০ টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে।

তবে সরকারের শীর্ষ মহলের আশঙ্কা, বোরো ও আউশে ফলন কম হওয়ায় এবার নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে চালের দাম বাড়তে পারে। তাই বাড়তি মজুত গড়তে সরকার চারটি দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে ১০ লাখ টন চাল ও গম কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ১০ লাখ টন চাল কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে গম কেনার ক্ষেত্রে অনুমোদনের দরকার হয় না। সরকার এরই মধ্যে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তড়িঘড়ি করে ‘বেশি দামে চাল কেনার’ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জাতিসংঘের প্রাক্কলন বলছে, ৩৭টি দেশের ৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এত কম খেতে পায় যে তারা মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে বা এর মধ্যেই অনাহার ও মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নিলে ২০২২ সালে ৯ লাখ ৭০ হাজার মানুষ দুর্যোগময় পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও ইয়েমেন খাদ্যসংকটে সর্বোচ্চ সতর্কতার স্তরে রয়েছে। কারণ, এসব দেশের মানুষ এর মধ্যে অনাহারের মুখোমুখি হয়েছে বা হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে অথবা তারা দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে নামার ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, এসব দেশে আগে থেকে তীব্র খাদ্যসংকট আছে।

ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলি বলেন, খাদ্যের অভাব ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শুধু দুর্ভিক্ষই হবে তা নয়, বরং এর জেরে বিভিন্ন দেশে বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়াতে আরব দুনিয়াসহ বিশ্বের ধনকুবেরদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁরা যদি কয়েক দিনের মুনাফাও এই খাতে দেন, তাহলে সংকট অনেকটা কাটানো সম্ভব।

গত সপ্তাহে এফএও, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, ডব্লিউএফপি ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এক যৌথ বিবৃতিতে বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের কথা তুলে ধরে জরুরি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। জাতিসংঘের বিশেষ উদ্যোগে ইউক্রেন থেকে ৩০ লাখ টন খাদ্য সরবরাহের পাশাপাশি বিশ্ব সংস্থাগুলো মিলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। খাদ্যসংকট মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক ৩ হাজার কোটি ডলারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। আইএমএফ খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে ঋণসহায়তা দেবে। আর কৃষিতে সার ব্যবহারে দক্ষতা বাড়াতে দেশে দেশে মাটির পুষ্টি মানচিত্র চালুর পাশাপাশি বেশ কিছু নীতিগত সুপারিশ করেছে এফএও। এই সংকটকালে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করার চলমান প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছে সংস্থাগুলো।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...