জাপানে করোনার চেয়ে বেশি মৃত্যু আত্মহত্যায়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক,

  • প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০২০, ৭:২৯ অপরাহ্ণ

জাপানি নাগরিক এরিকো কোবায়াশি প্রথমবার আত্মহত্যা চেষ্টা করেন ২২ বছর বয়সে। বাসা ভাড়া এবং দোকানের বিল পরিশোধ করতে না পারায় হতাশা থেকে আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। ওই ঘটনার পর তিনি হাসপাতালে তিনদিন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, দরিদ্রতার কারণেই তিনি আত্মহত্যা চেষ্টা করেন। এরপর তিনি আরও তিনবার একইভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন হতাশার কারণে।

বর্তমানে কোবায়শির বয়স ৪৩ বছর। নিজের মানসিক অসুস্থতা ও অভিজ্ঞাতা নিয়ে তিনি বই-ও লিখেছেন। একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করছিলেন কোবায়শি। সব মিলিয়ে মানসিক সমস্যা কিছুটা কাটিয়েও উঠছিলেন । তবে করোনাভাইরাসের মহামারি তার মধ্যে আবারও মানসিক অস্থিরতা তৈরি করছে।

তিনি জানান, করোনার কারণে তার বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি কোনও আশা দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি শঙ্কা করছেন আবারও দরিদ্রতার। শুধু কোবায়শিই নন, জাপানের অনেক নাগরিকই করোনার কারণে নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কা অনুভব করছেন, মানসিক অসুস্থতায় ভূগছেন।

বিশেষজ্ঞরা করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব জুড়ে মানসিক অসুস্থতা বাড়তে পারে বলে আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ব্যাপক বেকারত্ব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং মানসিক চাপ বিশ্বব্যাপী মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলেও জানিয়েছেন। জাপানে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরো বছরে দেশটিতে করোনায় যত মানুষ মারা গেছেন সেই তুলনায় শুধু অক্টোবর মাসেই বেশি মানুষ মারা গেছেন আত্মহত্যায়। জাপানের ন্যাশনাল পুলিশ এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে জাপানে আত্মহত্যা করেছেন ২১৫৩ জন। অন্যদিকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে করোনায় মারা গেছেন ২০৮৭ জন।

জাপানের ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও আত্মহত্যা বিশেষজ্ঞা মিচিকো উয়েদা বলেন, করোনায় আমাদের এখানে লকডাউনও ছিল না। অন্যান্য দেশের তুলনায় করোনার প্রভাবও খুব কম ছিল। কিন্তু তারপরও এখানে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে অন্যান্য দেশে ভবিষ্যতে আত্মহত্যার সংখ্যা একই রকম, এমনকি আরও বাড়তে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, অনেকদিন ধরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যার রেকর্ড রয়েছে জাপানে। ২০১৬ সালে , জাপানে আত্মহত্যায় মৃত্যুর হার ছিল প্রতি ১ লাখে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাপানের উচ্চ আত্মহত্যা হারের কারণগুলো বেশ জটিল। তবে দীর্ঘ সময় কাজ, পড়াশোনার চাপ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানা অজ্ঞতার কারণে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।

২০১০ সালের দিকে দশ বছরের জন্য জাপানে আত্মহত্যার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত বছর এটি প্রায় ২০ হাজারে নামে নামে। ১৯৭৮ সালে আত্মহত্যার রেকর্ড রাখা শুরুর পর থেকে এটিই ছিল বছরে আত্মহত্যায় সর্বনিম্ন মৃত্যু।

তবে মহামারির কারণে আত্মহত্যার এই হার আবার বেড়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় এ বছর ৮৩ শতাংশ বেশি নারী আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে পুরুষের মধ্যে এই হার বেড়েছে ২২ শতাংশ। এর অনেক কারণও জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। অনেক নারী হোটেল, খাদ্য পরিষেবা এবং রিটেল বাণিজ্যে খণ্ডকালীন কাজ করেন। করোনার কারণে অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। এ থেকে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।

কোবায়াশি বলেন, তার অনেক বন্ধুই কাজ হারিয়েছেন। তিনি আরও বলে, জাপান নারীদের অবজ্ঞা করছে। তার ভাষায়, এটা এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে কোনও কিছু খারাপ ঘটলেই প্রথমেই দুর্বলদের ওপর আঘাত আসে।
জাপানি গবেষকদের মতে, করোনায় সমস্যা বাড়ছে শিশু, কিশোরদেরও। যাদের বয়স ২০ বছরের নীচে, তাদের মধ্যে সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে। সামাজিক জীবন থেকে সরে আসা, স্কুল কলেজ বন্ধ থাকার কারণে শিশু-কিশোরদের জীবনে চাপ বাড়ছে। অনেক সময়ে বাড়িতে হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে শিশুদেরও। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মহামারির সময় জাপানের শিশুদের ৭৫ শতাংশ মানসিক সমস্যা ও চাপে ভুগছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ‘কেয়ার’ বিশ্ব ব্যাপী ১ লাখ লোকের ওপর জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, গোটা বিশ্বে মহামারির কারণে ২৭ শতাংশ নারী মানসিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। অন্যদিকে ১০ শতাংশ পুরুষ মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, আয় নিয়ে নারীরা নানা উদ্বেগের মধ্যে আছেন। অনেক নারীই সংসারের কাজ শেষে সন্তানদের স্কুল বা ডে কেয়ারে পাঠিয়ে কাজ করতেন। করোনার কারণে তারা সেটা পারছেন না। করোনার সময়ে সন্তানের সুরক্ষা নিয়েও তারা ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপে আছেন।

আখরি নামের ৩৫ বছর বয়সী এক জাপানি নারী জানান, অপরিণত সন্তান জন্ম নেওয়ায় শিশুটিকে ছয় সপ্তাহের জন্য হাসপাতালে রাখতে হয়েছিল। কিন্ত করোনার কারণে পুরোটা সময় তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি বলেন, এর আগে আমার কোনও মানসিক অসুস্থতার ইতিহাস ছিল না। তবে করোনার কারণে এখন আমি সারাক্ষণই উৎকণ্ঠায় ভূগি। ছেলে হয়তো করোনায় আক্রান্ত হবে এই ভেবে তিনি ভয় পেতেন।

জাপানে মানসিক অসুস্থতা ও একাকীত্ব এখনও অনেকে কলঙ্কজনক মনে করেন। অনেকে হতাশা নিয়ে কথা বলতেও লজ্জাবোধ করেন। কোবায়শি বলেন, একজনের দুর্বলতা অন্য একজনের জানা লজ্জাজনক মনে করে সবাই সবকিছু আড়াল করতে চান ও নিজের মধ্যে ধারন করেন। কিন্তু এ অবস্থা থেকে বের হতে আমাদের এমন সংস্কৃতি তৈরি করা দরকার যেখানে সবাই নিজের দুর্বলতা কিংবা দুঃখ প্রকাশ করতে পারবে।

জাপানে কবে এই আত্মহত্যার প্রবণতা কমবে, তা নিয়েও খুব একটা স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি দেশটির বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, শীতে দেশটিতে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হতে পারে। এতে করোনার প্রভাবে ধুঁকতে থাকা জাপানের অর্থনীতি আরও বড় ধাক্কার সামনে পড়তে পারে। এর ফলে অনেকের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা আরও বাড়বে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...