দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি রোধে ইসলামী নির্দেশনা

এস এম আরিফুল কাদের,

  • প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ৬:৫৫ অপরাহ্ণ


দুনিয়াবি বিপদগুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি অন্যতম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আয় অনুপাতে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হলে হতাশা আর পেরেশানি ব্যতীত অন্য কিছু করার থাকে না। যার কারণে শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতা তীব্র আকার ধারণ করে। শুরু হতে থাকে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইসহ বড় বড় অপরাধ প্রবণতা। পরিবার, সমাজ ও দেশের মানুষ হুমকির সম্মুখীন হতে হয়। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে থাকে ঘরে ঘরে। তা থেকে বাঁচতে বা কেটে উঠতে ইসলামি অনুশাসনের বিকল্প নেই। যার নমুনা প্রাক-ইসলাম থেকেও পেয়ে থাকি। হজরত ইউসুফ (আ.) আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পূর্ণাঙ্গভাবে হাতে-কলমে শিখিয়েছেন।

বর্তমান বিশ্বে প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় একটি মহামারির মতো ধারণ করেছে। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ সর্বক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে অপচয় আমরা করছি যা দিয়ে চাহিদাসম্পন্ন মানুষের চাহিদা পূরণ করা হয়তো সম্ভব হয়ে যেত। সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনুল কারিমে সতর্কতাপূর্বক এরশাদ হচ্ছে ‘হে আদম সন্তান! প্রত্যেক সালাতের সময় সুন্দর পোশাক পরিচ্ছদ গ্রহণ করো। আর খাও এবং পান করো। তবে অপচয় ও অসংযমতা করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না’ (সুরা আরাফ : ৩১)। অন্য আয়াতে অভাবগ্রস্তকে সহযোগিতার পাশাপাশি অপচয় রোধের মাধ্যমে সুন্দর সমাজ গঠনের ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দান করো এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপচয় করো না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। তুমি যদি তাদের (অর্থাৎ অভাবী আত্মীয়, মিসকিন ও মুসাফিরদের) পাশ কাটাতে চাও এজন্য যে, তুমি এখনো নিজের জন্য তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ লাভের সন্ধানে নিযুক্ত যা তুমি প্রত্যাশা করো, এমতাবস্থায় তাদের সঙ্গে নম্রভাবে কথা বলো। তোমার হাতকে তোমার গলার সঙ্গে বেঁধে (সহযোগিতা থেকে একেবারে বিরত) দিও না, আর তা একেবারে প্রসারিত (নিজের প্রয়োজন থাকার পরও) করেও দিও না, তা করলে তুমি নিন্দিত ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়বে। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তা যাকে ইচ্ছা অধিক জীবন উপকরণ দান করেন এবং তিনিই তা সংকুচিতও করে দেন। তিনি তার বান্দাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন এবং সবকিছুই দেখেন’ (সুরা ইসরা : ২৬-৩০)।

কালোবাজারিরা বেশি লাভের আশায় দ্রব্যমূল্য মজুদদারি করায় সংকট তৈরি হয়। হঠাৎ দ্রব্যাদির সরবরাহ বন্ধ হওয়াতে দ্রব্যসংকট সৃষ্টি হয়। এতে কখনো কখনো দেখা দেয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি। হতেও পারে নাশকতা চালিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে! কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চ থেকে নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের তো আয় বৃদ্ধি সম্ভব হয় না। এতে কালোবাজারিদের আয় বহুগুণে বেড়ে যায়, আর সর্বসাধারণের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাই এসব কালোবাজারিরা দেশের আইনানুযায়ী যেমন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, তেমনি ইসলামি আইনানুযায়ীও সে অভিশপ্ত। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের তাদের কৃত কোনো অন্যায় ছাড়াই কষ্ট দেয়, নিশ্চয়ই তারা বহন করবে অপবাদ ও সুস্পষ্ট পাপ’ (সুরা আহজাব : ৫৮)। মজুদদারি ও তাদের সঙ্গে একাত্মতা করে যারা দ্রব্য সংকট তৈরি করে তাদের জন্য ভয়ানক শাস্তি রয়েছে পরকালে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদের অনেকেই মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে। আর তারা আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং যারা সোনা ও রুপা জমা করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আজাবের সুসংবাদ দাও। সেদিন জাহান্নামের আগুনে ওইগুলোকে উত্তপ্ত করা হবে। অতঃপর ওইগুলো দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ এবং পৃষ্ঠদেশগুলোতে দাগ দেওয়া হবে, আর বলা হবে এটা হচ্ছে ওটাই যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে। সুতরাং এখন নিজেদের সঞ্চয়ের স্বাদ গ্রহণ করো’ (সুরা তাওবা : ৩৪-৩৫)। হাদিসে এসেছে, হজরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘নেককাজ ব্যতীত অন্য কিছু আয়ুষ্কাল বাড়াতে পারে না এবং দোয়া ব্যতীত অন্য কিছুতে তাকদির পরিবর্তন হয় না। মানুষ তার গুনাহের কারণে তার প্রাপ্য রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০২২)।

ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, অন্যান্য বিপদ-বিপর্যয়ের মতো এটাও একটা। তার প্রমাণ পবিত্র কোরআনুল কারিমে রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে ও স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তিনি তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (অসৎ পথ থেকে) ফিরে আসে’ (সুরা রূম : ৪১)। সুতরাং এই বিপর্যয় থেকে কেটে উঠতে তওবার বিকল্প নেই। তওবার ফলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের পাঁচটি মহান নিয়ামত দেবেন। তন্মধ্যে তিনটি দুনিয়ায় ও দুটি পরকালে। তা হলো উপকারী বৃষ্টি, নেক সন্তান, হালাল সম্পত্তি, অশেষ নিয়ামত জান্নাত এবং জান্নাতি নহর। এরশাদ হচ্ছে, ‘(আমি) বলেছি! তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি তো মহাক্ষমাশীল। (তোমরা তা করলে) তিনি অজস্র ধারায় তোমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তিনি তোমাদের সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন জান্নাত ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা’ (সুরা নুহ : ১০-১২)। এখন প্রশ্ন হলো কতবার তওবা (ইস্তিগফার) করতে হবে? তার সংখ্যা নিয়ে বহু সহিহ হাদিস বর্ণিত রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বনিম্ন ৭০ বার উল্লেখ করা যায়। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে ৭০ বারেরও অধিক ইস্তিগফার ও তাওবা করে থাকি’ (সহিহ বোখারি : ৫৭৫৪)।

আয়ের তুলনায় ব্যয়ভার বেশি হলে মহান প্রভুর কাছে প্রার্থনা করে তা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট’ (সুরা তালাক : ২-৩)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় রয়েছে, হজরত মালেক আশজায়ি (রা)-এর ছেলে হজরত আউফ (রা.) যখন কাফিরদের হাতে বন্দি ছিলেন। তখন তার পিতা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আসেন এবং তাকে এটা অবহিত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে আদেশ করলেন, “তুমি আল্লাহকে ভয় করো, ধৈর্য ধারণ করো এবং খুব বেশি বেশি ‘লা হওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ পাঠ করতে থাকো। একদা হঠাৎ করে হজরত আউফ (রা.)-এর বাঁধন খুলে যায় এবং তিনি সেখান থেকে পলায়ন করে বাইরে এসে বন্দিকারীদের একটি ছাগলের পাল দেখে সবগুলো হাঁকিয়ে নিয়ে আসেন। কাফেররা তার পেছন ধরে। কিন্তু তখন তিনি তাদের নাগালের বাহিরে চলে এসে তার বাড়ির দরজায় এসে ডাক দেন। ডাক শুনে তার বাবা বলেন, কাবার প্রতিপালকের শপথ! এটা তো আউফের কণ্ঠ। এ কথা শুনে তার মা বলেন, হায় কপাল! এটা আউফের কণ্ঠ কী করে হতে পারে? সে তো কাফিরদের হাতে বন্দি! অতঃপর বাবা, মা এবং খাদেম বাহিরে এসে দেখেন যে, সত্যিই তিনি আউফ (রা.)। গোটা প্রাঙ্গণ ছাগলে ভর্তি। বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, এ ছাগলগুলো কেমন করে আনলে? উত্তরে আউফ (রা.) পূর্ণ ঘটনাটি বর্ণনা করেন। বাবা বলেন, আচ্ছা, থামো। আমি এটা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করে আসি। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কথা শুনে বললেন, এগুলো সবই তোমার মাল। তোমার মনে যা চায় তাই করতে পারো। ওই সময়ই উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়” (তাফসির ইবনে কাসির(আরবি), অষ্টম খণ্ড, ১৪৭ পৃষ্ঠা)।

সর্বশেষ বলা যায় যে, অন্তত দুনিয়াবি শাস্তির অন্যতম শাস্তি দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি। তা থেকে বেঁচে থাকতে হলে উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় কাজে সরকারের সঙ্গে সবাই সহযোগিতার পাশাপাশি নিজেকে অপচয় থেকে বিরত রেখে ও তওবার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করা। মহান আল্লাহ আমাদের সুন্দর সমাজ গড়ার তওফিক দিন। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

Developed by: Web Design & IT Company in Bangladesh