স্বতন্ত্র করোনা ইউনিট চালুর ইচ্ছা নেই ওসমানী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের

এমজেএইচ জামিল,

  • প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ৭:২৮ পূর্বাহ্ণ

দেশব্যাপী ফের বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু। সিলেটেও বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। এক সপ্তাহে শনাক্ত বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এ অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেেেজর করোনা ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। কিন্তু কতটা প্রস্তুত করোনা ইউনিট- এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বহুল প্রতিক্ষিত ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্বতন্ত্র ‘করোনা ইউনিট’ চালুর জন্য প্রস্তুত থাকলেও সহসা করোনা চিকিৎসার জন্য চালু হচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অর্থায়নে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে বৈদ্যুতিক মিটার স্থাপনের কাজও শেষ করেছে। তবে প্ল্যান্টটি চালুর আগে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ওসমানী হাসপাতাল থেকে ২ জন স্টাফকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। তারা প্রশিক্ষণ নেয়ার পরই পুরোপুরিভাবে চালু হবে বহুল প্রতিক্ষিত সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট। অপরদিকে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অর্থায়নে নির্মিত অক্সিজেন প্ল্যান্টটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝে নিয়েছেন। এর ফলে যে কোন ক্রাইসিসে অক্সিজেন সক্ষমতা নিয়ে কোটি মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবে সিলেট বিভাগের বৃহৎ এই চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানটি।
তবে হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে করোনা বাড়লেও সিলেটে করোনা রোগীর কোন চাপ নেই। করোনা ডেটিকেটেড হাসপাতালে ৫-৬ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। তাই এই মুহুর্তে ওসমানীর ৪৫০ শয্যার স্বতন্ত্র করোনা ইউনিট চালুর কোন ইচ্ছা নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। ওসমানীর পুরনো বিল্ডিংয়ে রোগীদের সীট না থাকায় বিপুল সংখ্যক রোগীকে ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এই ইউনিটকে অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসার জন্য খুলে দিতে আগ্রহী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই আলোকেই ইউনিটকে চালু করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে ঐ সূত্রটি। করোনা ইউনিটের জন্য নির্মিত ওয়ার্ডকে মেডিসিন কিংবা সার্জারী রোগীদের জন্য খুলে দিলে এর বিশেষত্ব বিনষ্টের শঙ্কা করছেন অনেকে।
সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ওসমানী হাসপাতালের নতুন বিল্ডিং ঘেষে নির্মিত টিনসেডের ঘরে বসানো হয়েছে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অর্থায়নে নির্মিত অক্সিজেন প্ল্যান্ট। সবকিছু প্রস্তুত থাকার পরও কেবল চালুর অপেক্ষায় প্ল্যান্টটি। অপরদিকে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অর্থায়নে মেডিকেল কলেজের পাশে নির্মিত অক্সিজেন প্ল্যান্টটি পুরোপুরি প্রস্তুত। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে চালুর মাধ্যমে এর সক্ষমতাও পরীক্ষা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের মানুষের চিকিৎসাসেবার সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। গেল বছরের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে করোনা পরিস্থিতি ছিল শোচনীয়। প্রতিদিন হাজারো মানুষ নতুন করোনা রোগী হিসেবে শনাক্ত হচ্ছিলেন। তখন হাসপাতালগুলোতে শয্যা পাওয়া ছিল ‘হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো’ বিষয়! এমনও হয়েছে, করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়, এমন হাসপাতালগুলোর করোনা ইউনিটের বাইরে রোগী নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন স্বজনরা।
কেউ সুস্থ হয়ে বেরিয়ে গেলে তবেই মিলেছে শয্যা। যারা গুরুতর রোগী ছিলেন, তাদের হাহাকার ছিল আরও ভারী। আইসিইউ সংকটের কারণে রোগী নিয়ে স্বজনদের বুক চাপড়ানো ছিল তখন নিত্যদিনকার বিষয়। ‘কেউ যদি মারা যায়! মারা গেলে শয্যা মিলবে’- আইসিইউয়ের বাইরে ছিল এমনই আকুল অপেক্ষা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে, এমন চিন্তায় ২০২০ সালের শেষদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠায় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রস্তাবনায় ৪শ শয্যার একটি করোনা ইউনিট চালুর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চাওয়া হয়। হাসপাতালের নতুন আউটডোর ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় এই ইউনিট চালু করার প্রস্তাব দেয় কর্তৃপক্ষ। এজন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপনে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়।
কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ২০২১ সালের এপ্রিলে পুনরায় প্রস্তাব পাঠানো হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন সিলেট-১ আসনের সাংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। গেল বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী চিঠি পাঠান মন্ত্রণালয়ে। চিঠিতে উল্লেখ ছিল, ‘সিলেটে যে হারে সংক্রমণ বেড়েছে তাতে ওসমানীর প্রস্তাবিত করোনা ইউনিট দ্রুত চালু করা প্রয়োজন।
অক্সিজেন লাইন দ্রুত স্থাপন করে এটি চালু করলে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আর যদি সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপনে দেরি হয় কিংবা অপরাগতা প্রকাশ করা হয়, তাহলে সিলেট সিটি করপোরেশন অনুমতি পেলে নিজস্ব খরচে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করে দেবে।’
গত বছরের ৩ আগস্ট সিলেটের করোনা পরিস্থিতি ও ওসমানী হাসপাতালের করোনা ইউনিট চালুর বিষয়ে নগরভবনে নাগরিক সভা করেন মেয়র আরিফ। ভার্চুয়াল মাধ্যমে সভায় যোগ দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। সভায় মোমেন জানান, করোনা ইউনিট চালুর বিষয়টি নিয়ে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গেল আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য সিলেট সিটি করপোরেশনের অনুকূলে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত হওয়ায় অর্থ আসে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে।
প্রাপ্ত অর্থের সঙ্গে নিজস্ব তহবিল থেকে ৭৯ লাখ টাকা যোগান দিয়ে ওসমানী হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ করে সিসিক। গেল বছরের ২৫ অক্টোবর প্ল্যান্ট স্থাপনে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ওসমানী হাসপাতালের নতুন আউটডোর ভবনের উত্তর দিকে বসানো হয় এই প্ল্যান্ট।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে ওসমানী হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। গেল সপ্তাহে বৈদ্যুতিক মিটার স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। প্ল্যান্টটি পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত কয়েকজন স্টাফ দরকার। তাই ওসমানী হাসপাতাল থেকে ২ জন স্টাফকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্ল্যান্ট চালুর চিন্তা করছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য আরো সপ্তাহখানেক সময় লাগতে পারে বলে জানান তিনি।
এদিকে, ওসমানী হাসপাতালের আউটডোর ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় অক্সিজেন সরবরাহ লাইন স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। এই লাইন স্থাপনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছিল। গণপূর্ত বিভাগ কয়েক মাস আগে এই কাজ শেষ করেছে।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা: এম এ গাফফার বলেন, ওসমানী হাসপাতালে একই সময়ে ২টি পৃথক অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণ হয়েছে। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নির্মিত প্ল্যান্ট পরীক্ষামূলকভাবে চালুর পর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাজ থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝে নিয়েছেন। অপরদিকে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্মিত অক্সিজেন প্ল্যান্টটি চালুর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। পরীক্ষামূলকভাবে চালুর পর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্ল্যান্টটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝে নিবে।
তিনি বলেন, সিলেটে করোনা রোগীর কোন চাপ নেই। আর করোনা রোগীদের জন্য যে আলাদা ইউনিট চালুর কথা ছিল। সেই ইউনিটটি সাধারণ মেডিসিন ও সার্জারী রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা: নূরে আলম শামীম বলেন, বেশ কিছুদিন থেকে দেশে করোনার তেমন চাপ ছিলনা। তাই এক্ষেত্রে খোঁজ খবর নেয়া কিছুটা কমেছে। তাই এই মুহুর্তে ওসমানী হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ব্যাপারে আমার তেমন কিছু জানা নেই।
তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে করোনা বাড়ছে। তবে আগের পর্যায়ে যাওয়ার শঙ্কা তেমন নেই। কারণ ভ্যাক্সিনেশনের কারণে করোনার ঝুঁকি অনেক কমে গেছে। সিলেটের ক্ষেত্রে করোনা পরিস্থিতির মোটামুটি ভালো উন্নতি হয়েছে। করোনা রোগী আর ততটা বৃদ্ধির আশঙ্কা নেই।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...