৬ বছরেও চালু হয়নি খাদিমপাড়া ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল

বিশেষ প্রতিবেদক,

  • প্রকাশিত: ৫ ডিসেম্বর ২০২২, ৮:০৩ অপরাহ্ণ

উদ্বোধনের ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি খাদিমপাড়া ৩১ শয্যা হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম। ফলে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন এই এলাকার মানুষজন। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের সদর উপজেলার খাদিমে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালটিতে নেই ওষুধ, নেই রোগ নির্ণয়ের কোনো যন্ত্রপাতি। টেকনিশিয়ানও নেই। অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও চালক নেই। চিকিৎসক-সেবিকাসহ লোকবলেরও সংকট রয়েছে। এ ছাড়া উদ্বোধনের ছয় বছরেও এই হাসপাতালে শুরু হয়নি ইনডোর সেবা কার্যক্রম। রোগী ভর্তির জন্য আর্থিক আর প্রশাসনিক অনুমোদনও পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, খাদিমপাড়া ৩১ শয্যা হাসপাতালটি জেলা বা উপজেলা হাসপাতালের মতো নয়। বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতালের জন্য আলাদা আর্থিক ও প্রশাসনিক অনুমোদন প্রয়োজন। তবে নানা জটিলতায় তা এখনও সম্ভব হয়নি।

খাদিম হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগে ভিড় করে আছেন শতাধিক রোগী। টিকিট কেটে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এসেছেন তারা। তাদেরই একজন রহিমা বেগম।
খাদিম দাসপাড়া এলাকার বাসিন্দা এই বৃদ্ধা বলেন, ডাক্তারের কাছে এলেই বিভিন্ন টেস্ট লিখে দেন। কিন্তু এখানে রক্ত পরীক্ষাও করানো যায় না। এখানে কোনো ওষুধও পাওয়া যায় না। এসবের জন্য আমাদের শহরে যেতে হয়। অনেক সময় চিকিৎসকও পাওয়া যায় না।

মনির হোসেন নামের আরেক রোগী বলেন, হাসপাতাল বলা হলেও এটি আসলে অনেকটা ডাক্তারের চেম্বারের মতো। এখানে একটু কম পয়সায় ডাক্তার দেখানো যায়- এটুকুই লাভ। আর কোনো সুবিধা নেই।

সিলেট সদর উপজেলায় কোনো সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেই। এখানকার রোগীদের যেতে হয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এই হাসপাতালের ওপর চাপ কমানো এবং সদর উপজেলাবাসীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে খাদিমনগর হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে হাসপাতাল নির্মিত হলেও তার সুফল পাচ্ছেন না উপজেলার বাসিন্দারা।

কথা হয় হাসপাতালের প্রশাসনিক এক কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্যোগে এই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্মাণের আগে অবকাঠামো ছাড়া আর কিছু করার চিন্তা করা হয়নি। কিন্তু হাসপাতালের জন্য আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। এসবের কিছুই এখানে নেই।

হাসপাতালের সংকটের চিত্র তুলে ধরে এই কর্মকর্তা বলেন, এখানে কোনো ওষুধ নেই। আলট্রাসনোগ্রাম ছাড়া রোগ নির্ণয়ের আর কোনো যন্ত্র নেই। এমনকি রক্ত পরীক্ষাও করা যায় না। টেকনোলজিস্ট ও রেজিওলজিস্টের পদও শূন্য। অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও চালক নেই। ফলে এটি ব্যবহার করা যায় না।

তিনি বলেন, অবকাঠামোগত সুবিধা এবং চিকিৎসক থাকার পরও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র না থাকায় এখানে রোগী ভর্তি করা যায় না। মাঝে মাঝে দু-একজন ভর্তি হলেও তাদের সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না।

করোনাকালীন আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ঘোষণা করে এই হাসপাতালে করোনার উপসর্গ থাকা ও আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি করা হয়। করোনার প্রকোপ কমার পর বন্ধ হয়ে যায় ইনডোরের কার্যক্রম।

হাসপাতালটিতে চিকিৎসকের পদ আছে ১০টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ছয় জন। তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসকের পদটিও শূন্য রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে রয়েছেন ডা. আব্দুল হারিছ।

তিনি বলেন, লোকবল সংকট ও অর্থ ছাড় না পাওয়ায় হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না। চিকিৎসক নার্সের পাশাপাশি এখানে সব পদেই লোক সংকট রয়েছে। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে কোনো পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়নি।

আব্দুল হারিছ বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে ইনডোরেও কিছু রোগী ভর্তি থাকেন। তবে বহির্বিভাগের কার্যক্রম দুপুর ১টায় বন্ধ হয়ে যায়। ভর্তি রোগী না থাকলে তখন হাসপাতালের ফটকও বন্ধ করে দেয়া হয়।

এই হাসপাতালের ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতর সিলেটের পরিচালক হিমাংশু লাল রায় বলেন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে হাসপাতালটি নির্মিত হয়েছিল। রাজনীতিবিদরা যখন প্রতিশ্রুতি দেন, তখন কেবল ভবন নির্মাণের চিন্তা করেন। কিন্তু হাসপাতালের জন্য যে অর্থছাড় ও লোকবলের অনুমোদন করাতে হয়, তা তারা চিন্তা করেন না। ফলে অবকাঠামো নির্মিত হলেও বাকি প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন না হওয়ায় হাসপাতাল দুটি চালু করা যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, হাসপাতালের ইনডোর কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। এ জন্য অর্থ ছাড়, লোকবল নিয়োগ প্রয়োজন। এ ছাড়া ইনডোরে ভর্তি রোগীর খাবারেরও জন্য অর্থ প্রয়োজন। এসব না পাওয়ায় ইনডোর কার্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না।

হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম চালুর প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে হিমাংশু বলেন, এটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের মতো নয়। এমন হলে নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক ও অর্থছাড় পাওয়া যেত। হাসপাতাল পরিচালনায় একটি ব্যবস্থাপনা কমিটিও থাকত। কিন্তু এটি একটি বিশেষ ধরনের হাসপাতাল। ফলে এর অর্থছাড়, প্রশাসনিক অনুমোদন, লোকবল নিয়োগে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। নতুন করে পদ সৃষ্টি করতে হচ্ছে। তবে আমরা এ নিয়ে মন্ত্রাণলয়ে লিখেছি। আশা করছি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

এই হাসপাতাল চালু না হওয়ায় উপজেলাবাসী দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জানিয়ে সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ বলেন, ওসমানী হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে সব সময়ই চার-পাঁচ গুণ বেশি রোগী থাকেন। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পান না রোগীরা। এ ছাড়া সদর উপজেলাসহ আশপাশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুমূর্ষু রোগীদের ওসমানী হাসপাতালে অনেক সময় নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয় না। কিন্তু এই এলাকায় একটি হাসপাতাল হলেও তা থেকে লোকজন সেবা পাচ্ছেন না।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...