প্রয়াত কমরেড শ্রীকান্ত দাশ : মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে গণসংগীত ছিল যার প্রতিবাদের ভাষা

মতিয়ার চৌধুরী, লন্ডন,

  • প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০২৩, ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসন—শোষণ থেকে মুক্তি আর স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজ, রাষ্ট্রীয় ও গরিবের সম্পদ আত্মসাৎ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া ও স্বৈরাচার এবং মৌলবাদবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে গণসংগীত ছিল যার প্রতিবাদের ভাষা তিনি হলেন বৃহত্তর সিলেটের কৃতিসন্তান সর্বজন শ্রদ্ধেয় কমরেড শ্রীকান্ত দাশ।

গণসংগীত নিয়ে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে বিচরণ করতেন কমরেড শ্রীকান্ত দাশ। রণাঙ্গনের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা সৈনিক, বৃহত্তর সিলেট বিভাগের ভাটি অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনের নেতা, কৃষকদের যারা শোষণ করতো নানাভাবে নিপীড়ন নির্যাতন করতো তাদের বিরুদ্ধে ছিলেন এক প্রতিবাদী কণ্ঠ। জোতদার গোষ্ঠীর কাছে ছিলেন ভয়ংকর নেতা। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য। ১৯ নভেম্বর ছিল এই কৃতি সন্তানের মৃত্যুদিবস। জাতির এই শ্রেষ্টসন্তানকে তার মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। যে মানুষটি লোভ লালসার উর্ধে থেকে আজীবন মাটি ও মানুষকে ভালবেসে দেশ ও জতির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশে রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়েছে তিনি ক্ষমতা বা অর্থের লোভে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। এই বীরের প্রয়াণ দিবসে তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই।

১৯২৪ সালের ৫ জুলাই সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার আঙ্গারুয়া গ্রামে কমরেড শ্রীকান্ত দাশ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা যোগেন্দ্র কুমার দাশ ও মাতা জ্ঞানদায়িনী দাশ। ৮ মাস বয়সে মাকে হারান। বাবার কাছ থেকেই মূলত সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে থাকায় পড়াশুনার সময় থেকেই শিক্ষকের সাথে মিছিলে যোগ দিয়ে বন্দে মাতারম শ্লোগান দিতেন। হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার বাল্লা জগন্নাথপুর গ্রামে মামার বাড়িতে শ্রীকান্ত দাশের শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি।

১৯৩৯ সালের ৭ নভেম্বর তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমা শহরে ভারতবর্ষের জাতীয় কংগ্রেস নেতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আগমন ঘটলে কমরেড শ্রীকান্ত দাশ নেতাজীর গলায় ফুলের মালা পড়িয়ে দেন। ১৯৪৩ সালে কমরেড করুনাসিন্ধু রায়ের কাছে রাজনীতিতে তালিম নিয়ে সক্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেন। ১৯৪৩ সালে সুরমা উপত্যাকায় ৮ম কৃষক সম্মেলনে কমরেড শ্রীকান্ত দাশ প্রথম গণসংগীত পরিবেশন করে সকলের নজরে আসেন।

সেখানে উপস্থিত ছিলেন করুনাসিন্ধু রায় (কমরেড বরুন রায়ের বাবা), লালা শরদিন্দু দে, অজয় ভট্টাচার্য, সুরত পাল, বীরেশ মিশ্র, ইরাবত সিংহ, কমরেড মনি সিংহ, রাখাল বাবু, কমরেড আদম আলী, কমরেড তারা মিয়া, প্রবোধ নন্দ কর, সত্যেন সেন, রনেশ দাশগুপ্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী। কমরেড শ্রীকান্ত দাশ পার্টির বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে চিহ্নিত হন। নেতৃবৃন্দ তাকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করার নির্দেশ দেন। কারন কমরেড শ্রীকান্ত দাশের কণ্ঠে যে গণসংগীত নিঃসৃত হতো তা যেমন সোচ্চার কণ্ঠের ধ্বনিত হতো, তেমনি কোমলতার স্পর্শে বিশেষ ভঙ্গিমা লাভ করত।

হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার বাল্লা জগন্নাথপুরে গণসংগীত, পথসভা, গ্রামীণ বৈঠকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকনায় সর্ব ভারতীয় কৃষক সম্মেলনে কমরেড শ্রীকান্ত দাশ যোগদান করেন।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দিরাই উপজেলার কৃতি সন্তান সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে নিজ উপজেলা শাল্লায় অপারেশন করেন এবং দিরাই যুদ্ধে গ্রুপ কমান্ডার সুধীর দাশের সঙ্গে সশস্ত্রভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে নিজ হাতে লংগরখানা খুলেছেন। সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনেও তাঁর ভুমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পরিমল হাজং এর মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে করমর্দনের স্মৃতি তাঁর জীবনের আনন্দের স্মৃতি।

২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর কমরেড শ্রীকান্ত দাশ মৃত্যুবরণ করেন। জীবিত থাকাকালীন কমরেড শ্রীকান্ত দাশ নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে দেহ চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণার জন্য সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে দান করে গেছেন। চোখ দুটো সন্ধানীকে দান করে গেছেন।

কমরেড শ্রীকান্ত দাশের স্ত্রী হলেন ছায়া রানী দাশ। তাঁর সাত সন্তান হলেন আল্পনা তালুকদার, দুরন্ত দাশ, জল্পনা রাণী সরকার, কল্পনা রাণী তালুকদার, সুকান্ত দাশ, কবিতা রাণী দাশ, সুশান্ত দাশ। কমরেড শ্রীকান্ত দাশের স্ত্রী ছায়া রানী দাশ জীবিত থাকা অবস্থায় নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে নিজের দেহ দান করেছেন। কমরেড শ্রীকান্ত দাশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। তার সকল সন্তানেরাও পিতার মত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী।

 

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...