সব
স্বদেশ বিদেশ ডট কম
তোমার আগমনে এলো পূর্নতা; রক্তে কেনা বাঙ্গালীর স্বাধীনতা ; ১০ জানুয়ারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পর মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাকে থাকতে হয় পাকিস্তানের কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। এ সময় প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে প্রবাসী সরকার তার নির্দেশনা অনুসরণ করে স্বাধীনতা অর্জনের পথে মুক্তিযোদ্ধা, জনতা ও মিত্রবাহিনীর যৌথ সংগ্রামে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে বাঙালীর বিজয় চূড়ান্ত রূপ নিতে শুরু করে.। বৃটেন আমেরিকা সহ বিভিন্ন প্রবাসী বাঙালীদের সংগ্রাম ও ক্যম্পেইনের ফলে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হলে পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয় তাকে সসম্মানে মুক্তি দিতে। এর আগে পাকিস্তানের কারাগারে গোপনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সকল প্রকার আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এ ঘটনা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৬৭টি দেশের সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি দেন। অন্যদিকে তিনি ইউরোপের ৫টি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে বিশ্বজনমত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন। ফলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। নয় মাস ১৪ দিন কঠিন কারাভোগ করে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারী পাকিস্তানে বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান। একটি পাকিস্তান সামরিক বিমানে খুব গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ বিমানে আরও ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তার পরিবার।
৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি’র ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।’ লন্ডনে সময় তখন ভোর ৮টা ৩০ মিনিটে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেট প্লেনটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর নেমে বঙ্গবন্ধু ভিআইপি লাউঞ্জে আসলে তাকে ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের উপস্থিত কিছু কর্মকর্তা স্বাগত জানান। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে জানান ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন। সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে বলেন ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট।’
বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ওয়েস্ট অ্যান্ড এর ক্লারিজ হোটেলের উদ্দেশে রওনা দেন। গাড়িতে ওঠার সময় তিনি সামনে বসতে পারেন কিনা জিজ্ঞাসা করলে কর্মকর্তারা বলেন, অবশ্যই। এসময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনও কথা বলেননি।
ইউএনআই পরিবেশিত নয়াদিল্লির খবরে বলা হয়, মুক্তির পর প্রথম বিবৃতিতেই বঙ্গবন্ধু নিজ ইচ্ছায় লন্ডনে গিয়েছেন বলে দেওয়া পাকিস্তানের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাঁকে ব্রিটিশ রাজধানীতে পাকিস্তানের সিদ্ধান্তেরই পাঠানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি বন্দি ছিলাম, পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমার সিদ্ধান্তে নয়।’ অথচ নয়াদিল্লি থেকে পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় লন্ডন ভ্রমণের অভিপ্রায় জানান।
পরবর্তীতে হোটেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, ‘তিনি আগামীকাল বা পরের দিন ঢাকা ফিরবেন বলে আশা করছেন। বাংলাদেশ শিগগির জাতিসংঘে সদস্য পদের জন্য অনুরোধ করবে। বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থনের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্সকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন অবিসংবাদিত সত্য এবং এদেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তাকে নজীরবিহীন সম্মান দেখান। ইতিহাস সাক্ষী ঐদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড নিজে তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ শেখ মুজিব গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন। এদিকে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জেনে হাজার হাজার বাঙালী হোটেল ঘিরে ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন ‘এক মুহূর্তের জন্য আামি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি, আমি জানতাম ওরা আমাকে হত্যা করবে আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাব না, কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে।’
বাংলাদেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করে দিল্লীতে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। লন্ডনে এবং দিল্লী উভয় জায়গাতেই তিনি পেয়েছিলেন বীরোচিত সংবর্ধনা।
তারপর দিল্লি হয়ে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যে জাতির মননে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বুনেছিলেন, সেই দেশের রক্তভেজা মাটিতে তিনি ফিরে এলেন বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে রক্তস্নাত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন. জীবন-মৃত্যুর কঠিন চ্যালেঞ্জের ভয়ঙ্কর অধ্যায় পার হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মহান এ নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতা পায় মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়.। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানায়.। ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে বিকাল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু সেদিন আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন যে, তাঁর সারাজীবনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেয়া হবে না বলে উল্লেখ করে সশ্রদ্ধ চিত্তে তিনি সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন, সবাইকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন।সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২৩ সদস্য বিশিষ্ট আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে।স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম সরকারের সাফল্য ছিল যুদ্ধবিধস্ত দেশ পুনর্গঠন এবং প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন। বঙ্গবন্ধু সরকার অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এই গুরু দায়িত্ব সম্পন্ন করে। দুর্ভিক্ষের যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সরকার তা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করে। সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশ সেই মুহূর্তে অল্প সময়ের মধ্যে শতাধিক রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতা লাভের তিন মাসের মধ্যেই বাংলার মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাবর্তন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ জারিকৃত প্রেসিডেন্সিয়াল আদেশ বলে গণপরিষদ গঠন করে নভেম্বর মাসের মধ্যেই দেশের জন্য একটি সংবিধান উপহার দেয়া হয় এবং যা কার্যকর হয়.। আজ বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় সেই ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দিনটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে এবং থাকবে.।
অথচ আজকের অবৈধ দখলদার ফ্যাসিস্ট ইউনূস সরকার বাংলাদেশ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিসাৎ করার এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। রাষ্ট্রাচার থেকে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ দিবস, সংবিধান দিবস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বরণের দিবস বা জাতীয় শোক দিবসসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিবস বাতিল করা হয়েছে। এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ তাদের প্রতিবাদ করে চলেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। প্রতিবছর কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি নানা আয়োজনে পালন করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বরাবরের ন্যায় এবারও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
জয় বাংলা. জয় বঙ্গবন্ধু.জয় হোক মানবতার. বাংলাদেশ চিরজীবী হোক ।
লেখক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ মকিস মনসুর,
(লেখক পরিচিতি:- ৯০ এর গন-আন্দোলনের বাংলাদেশের সাবেক ছাত্রনেতা বৃটেনের কমিউনিটি লিডার ও সাংবাদিক মোহাম্মদ মকিস মনসুর.যুক্তরাজ্য যুবলীগের সাবেক সহ সভাপতি. ইউকে ওয়েলস যুবলীগের প্রাক্তন সভাপতি. ইউকে ওয়েলস ছাত্রলীগ সাবেক প্রতিষ্ঠাতাকালীন সভাপতি ছাড়া ও যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় সদস্য, ওয়েলস আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি. হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন ইন ইউকের সভাপতি এবং বৃটেনের কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাদার ল্যাংগুয়েজ মনুমেন্ট ফাউন্ডার্স ট্রাষ্ট তথা শহীদ মিনার কমিটির সেক্রেটারি.সহ ইউকে বিডি টিভির চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব পালন করছেন.)
Developed by: Helpline : +88 01712 88 65 03