শ্রীমঙ্গলের স্কুলছাত্র ফাহাদের মৃত্যু রহস্যের জট খুলছে না

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ৮:১৫ অপরাহ্ণ

দীর্ঘ ২ মাসেও শ্রীমঙ্গলের আলোচিত স্কুলছাত্র ফাহাদ রহমান মারজানের মৃত্যুর রহস্যের জট খুলতে পারেনি রেলওয়ে থানা পুলিশ। ঘটনার পর থেকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়সারা তদন্তের অভিযোগ তুলেছেন নিহত ফাহাদের পরিবারের সদস্যরা। জিআরপির পক্ষ থেকে ট্রেনে কাটা পড়ে ফাহাদের মৃত্যু হয়েছে- এমন দাবি করা হলেও এ দাবি মেনে নিতে পারছে না নিহতের পরিবার। পরিবারের অভিযোগ পূর্বপরিকল্পিতভাবে ফাহাদকে হত্যা করে রেললাইনে রেখে দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

তবে অপমৃত্যু মামলাতেই আটকে রয়েছে রেলওয়ে থানা পুলিশ।

ফাহাদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মাথায় আঘাতজনিত কারণে ফাহাদের মৃত্যু হয়েছে। তবে কিসের আঘাত তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে- এমন আশঙ্কা থেকে ফাহাদের পিতা মোহাম্মদ ফজলুর রহমান বাদী হয়ে ১৩ অক্টোবর রেলওয়ে থানায় একটি হত্যা মামলার আবেদন করেন। কিন্তু পুলিশ তা আমলে না নেওয়ায় তিনি মৌলভীবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে, দুজনকে আসামি করে একটি অভিযোগ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২৬ অক্টোবরের মধ্যে ঘটনার আদোপ্রান্ত আদালতকে জানানোর জন্য শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জকে নির্দেশ দিলেও এখনো কার্যত কোনো অগ্রগতি নেই।

জানা যায়, শ্রীমঙ্গল উপজেলার পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার বাসিন্দা শ্রীমঙ্গল সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলুর রহমানের পুত্র ফাহাদ রহমান মারজানের (১৭) নিথর দেহ গত ১২ অক্টোবর সকালে শহরতলীর শাহীবাগ এলাকায় রেললাইনের পাস থেকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মাথায় রক্তাক্ত কাটা জখম ছিল। পরে রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক মোল্লা সেলিমুজ্জামান হাসপাতালে গিয়ে মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। নিহতের সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে মাথার বাম পাশে ৬ বাই ২ ইঞ্চি একাধিক কাটা জখম, কপালে ৩ বাই ১ ইঞ্চি কাটা জখম, পিঠে ২ বাই ৩ ইঞ্চি ছেছড়া দাগ এবং বাম পায়ের হাঁটুর নিচে হালকা ও বৃদ্ধাঙ্গুলে কাটা দাগ রয়েছে।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফাহাদের মরদেহ পোস্টমর্টেমের জন্য মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণকালে রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক মোল্লা সেলিমুজ্জামান নিহত ফাহাদের পিতা ফজলুর রহমানকে কম্পিউটারে প্রিন্টকৃত ‘ফাহাদ আগের দিন থেকে নিখোঁজ রয়েছে’ এবং ‘ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে’ লেখা একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলেন।

ফজলুর রহমান বলেন, এই কাগজে আমি স্বাক্ষর করিনি। ঘটনার তদন্তের আগেই এত কম সময়ের মধ্যে পুলিশ কীভাবে নিশ্চিত হলো আমার ছেলে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে? এছাড়া আগের দিন থেকে নিখোঁজ-পুলিশের এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ফাহাদ ঘটনার দিন ভোরে বাসা থেকে বের হয়। যা শহরের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরায় রয়েছে।

ফজলুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ১১ অক্টোবর রাত ১২টার দিকে ফাহাদ আমাকে জানায় ১২ অক্টোবর সকালে তার এসএসসির ব্যবহারিক পরীক্ষা আছে। রাত ১টার দিকে সে তার কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ১২ অক্টোবর সকাল ৯টার দিকে আমার স্ত্রী হাফেজা রহমান আমাকে জানায় ছেলে ফাহাদ বাসায় নেই। আমি তৎক্ষণাৎ তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে কল করলে ফোন ধরেন শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার এসআই সেলিমুজ্জামান। তিনি আমাকে জানান, আমার ছেলে ফাহাদ অসুস্থ এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি, আমার ভাই ইমাদ আলী ও আমার স্ত্রী দ্রুত শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে আমার ছেলেকে মাথায় মারাত্মক রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পাই।’ তিনি বলেন, ‘শহরের বিভিন্ন পয়েন্টের সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হই আমার ছেলেকে পূর্বশত্রুতার জের ধরে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, শুরু থেকেই রেলওয়ে থানা পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যময়। ফাহাদের মোবাইল ফোনের কললিস্ট নিয়ে তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এমন নানা অনাস্থা থেকে তিনি এ মামলার তদন্তভার পিবিআই, র‌্যাব বা সিআইডির মতো সংস্থার হাতে ন্যস্ত করার দাবি জানান। ঘটনার দিন সকাল অনুমানিক ৭টায় শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে কিমি ২৮৭/৭ অতিক্রম করে ঢাকা থেকে সিলেটগামী ৯ আপ লোকাল সুরমা মেইল ট্রেনের চালক জাহিদুল ইসলাম জানান, শ্রীমঙ্গলে রেলস্টেশন প্রবেশমুখে ট্রেনের গতি স্বাভাবিকভাবে কমিয়ে আনা হয়। যে ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে ট্রেনে কাটা পড়া বা ট্রেনের ধাক্কা এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।’ তিনি বলেন, ‘সেদিন আমি আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ট্রেনে চালকের দায়িত্বে ছিলাম। ওই রুটে ট্রেনে কাটা বা ট্রেনে ধাক্কা লাগার কোনো ঘটনা ঘটলে তা আমার জানার কথা। কিন্তু সেদিন ওই রুটে কোনো ঘটনা ঘটেনি তা আমি নিশ্চিত।’ ফাহাদ রহমান মারজানের মৃত্যু রহস্য নিয়ে অনুসন্ধানকালে জানা যায়, ফাহাদের সঙ্গে শহরতলীর মুসলিমবাগ এলাকার একটি মেয়ের সুসম্পর্ক ছিল। ফাহাদের নিথর দেহ যেখানে পড়ে ছিল সেখান থেকে ওই মেয়ের বাড়ি কাছাকাছি। ফাহাদের স্কুলের সহপাঠী মাসুক ইসলাম মুন্না বলেন, ‘এ নিয়েও কোনো ঝামেলা থাকতে পারে’।

পশ্চিম ভাড়াউড়ার বেকারি কর্মী হৃদয় আলী জানান, ঘটনার দিন ভোর ৫টার দিকে শহরের উকিল বাড়ি সড়কে নিহত ফাহাদকে অজ্ঞাত ৩ ব্যক্তির সঙ্গে হেঁটে যেতে তিনি দেখেছেন। একই এলাকার বাসিন্দা ফাহাদ ও হৃদয়। এ কারণে হৃদয় ফাহাদকে কোথায় যাচ্ছে প্রশ্ন করলে ফাহাদ জানায় রেলস্টেশনে নাশতা করতে যাচ্ছে।

ঘটনার দিন ভোরে জানে আলম নামে এক পরিবহন শ্রমিকের ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থল থেকে তার নিথর দেহ উদ্ধার করে। জানে আলম জানান, ট্রেন যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই তিনি অজ্ঞাত এক তরুণকে লাইনের পাশে ঝুপড়ির মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পরিচয় শনাক্ত করতে লাইভ করেন। ঘটনাস্থলে রেললাইনের ২০ গজের মধ্যে রয়েছে অনেক বাড়িঘর (বস্তি এলাকা)। সেখানকার কোনো বাসিন্দাই ট্রেনে কাটা পড়ে বা ধাক্কা লেগেছে এমন ঘটনা দেখননি বলে জানিয়েছেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক মোল্লা সেলিমুজ্জামান বলেন, ঘটনার তদন্ত চলমান রয়েছে। সিডিআর পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিষয়টির তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মামলার বাদীকে সব কিছু অবহিত করা হচ্ছে।

শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ সাফিউল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, অধিক গুরুত্ব সহকারে পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করে প্রাপ্ত ফলাফল জানাতে পারব। তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

ফাহাদ মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের আশায় ফাহাদের পিতা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের দ্বারে-দ্বারে ঘুরছেন। রেল বিভাগের ডিআইজি (ঢাকা) জয়দেব বর্ধনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। সিলেটের পুলিশ সুপার শরিফুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফাহাদের মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটনে সুষ্ঠু তদন্তের অনুরোধ জানান। তারা এ বিষয়ে আশ্বাস দিলেও কার্যত কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি বলে পরিবারের পক্ষে জানানো হয়েছে।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...