মার্চের আগে ১ কোটির বেশি শিক্ষার্থী সব বই পাবে না!

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১:০৯ অপরাহ্ণ

বছর জুড়ে প্রস্তুতি নেওয়ার পরও সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় সাড়ে ৩০ কোটি পাঠ্যবই ছাপা হবে, যার মধ্যে মাধ্যমিকের বই ২১ কোটি ৯০ লাখ। নবম শ্রেণির বইয়ের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ কোটি। গত অক্টোবর মাসের মধ্যে এসব বই ছাপানো শেষ করার টার্গেট ছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। কিন্তু এখন পর্যন্ত নবম শ্রেণির মাত্র ২০ লাখ বই ছাপা হয়েছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির সাড়ে ১৪ কোটি বই ছাপা এখনো শুরু হয়নি। এ কারণে আগামী মার্চ মাসের আগে, অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষের দুই মাস সব বই না পেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে প্রায় ১ কোটির বেশি শিক্ষার্থী।

গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে দেরিতে বই ছাপানোর বিষয়টি অনেকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল। কিন্তু এবার পাঠ্যবই বিলম্বে ছাপানোর বিষয়ে কোনো অজুহাত কেউ মানতে রাজি নয়। বিলম্বের জন্য ছাপাখানার মালিকরা দায়ী করছেন এনসিটিবির কর্মকর্তাদের গাফিলতিকে। অন্যদিকে এনসিটিবির কর্মকর্তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপরে দায় চাপিয়ে বলেন, পাঠ্যবই ছাপায় বিলম্বে এনসিটিবির কোনো দায় নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো কারণ ছাড়াই মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের ক্রয়াদেশে অনুমোদন না দিয়ে টেন্ডার বাতিল করেছিল। এ কারণেই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট ভাঙতেই পুনরায় টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিটেন্ডারেও সিন্ডিকেট ভাঙেনি। উলটো বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। অনেক ছাপাখানা রিটেন্ডারে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক কম দরে কাজ নিয়েছে। এতে নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

জানা গেছে—ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের প্রতি ফর্মায় সরকারের বাজেট ছিল ৩ টাকা ১৫ পয়সা। বাজারমূল্যে প্রতি ফর্মা ছাপাতে ন্যূনতম খরচ ২ টাকা ৪০ পয়সা। অথচ কয়েকটি প্রেস সিন্ডিকেট করে ১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ২ টাকা ৯ পয়সা পর্যন্ত রেট দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। পুনঃদরপত্রে আনন্দ প্রিন্টার্সের মালিক রব্বানী জব্বার এবং মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. কবিরের সিন্ডিকেট সদস্যরা এই কাজটি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রব্বানী-কবিরের প্রতিষ্ঠানের নিম্নমানের কাগজে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপানোর বিষয়টি ইন্সপেকশন প্রতিষ্ঠানের ল্যাব টেস্ট ও তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল।

জানা গেছে, এবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ করছে ১০৩টি ছাপাখানা। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির সাড়ে ১৪ কোটি বইয়ের মধ্যে অর্ধেকের বেশি কাজ পেয়েছে রব্বানী ও কবিরের প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই তুলে দিতে গত এপ্রিল মাসে কাজ শুরু করে এনসিটিবি। মে-জুলাইয়ে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। লক্ষ্য ছিল অক্টোবরের মধ্যে ছাপা শেষ করে ডিসেম্বরে সব উপজেলায় পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়া। তবে সেপ্টেম্বরের দিকে সে লক্ষ্যে ছেদ পড়ে। সরকারের ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটি ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ক্রয়াদেশে অনুমোদন না দেওয়ায় টেন্ডার বাতিল হয়ে যায়। রিটেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ক্রয়াদেশ পেতে সময় লেগেছে বাড়তি আড়াই মাস। পাশাপাশি নবম শ্রেণির প্রায় ৬ কোটি বই ছাপার ক্রয়াদেশের অনুমোদন দিতেও দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়। এতে পাঠ্যবই ছাপায় পিছিয়ে পড়ে এনসিটিবি। নবম শ্রেণির বইয়ের নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) জারি হয়েছে ২৭ অক্টোবর। নোয়ার পর ছাপাখানা মালিকরা চুক্তির জন্য ২৮ দিন সময় পান। নির্ধারিত সময়ে চুক্তি করলেও ছাপানো শুরু করতে ডিসেম্বর যাবে। এরপর ছাপানোর জন্য ৭০ দিন সময় পাবে। এতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস তারা ছাপানোর জন্য পাবেন। এছাড়াও বই বাঁধাই, ট্রাকে জেলা-উপজেলায় পৌঁছে দিতেও অনেক সময় লেগে যায়। অন্যদিকে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত তিন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) জারি হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। চুক্তি কার্যক্রম চলবে আগামী ২৮ দিন। এরপর ছাপা শুরু হবে।

এনসিটিবির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলাকেও এ সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। অভিযোগ আছে, বোর্ডে এখনো আগের সরকারের সুবিধাভোগীরা সক্রিয়। ছাত্রদল এক বিবৃতিতে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) ড. রিয়াদ চৌধুরী ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রবিউল কবীর চৌধুরীর অপসারণ দাবি করেছে। তারা অভিযোগ করেছে, এই কর্মকর্তারা বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ এবং সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা করছেন।

প্রাথমিকের ৩০ ভাগ কাগজ নিম্নমানের :এনসিটিবি বেসরকারি ‘তৃতীয় পক্ষের’ মাধ্যমে পরিদর্শন করালেও প্রতিবারই পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য নিম্নমানের কাগজে প্রাথমিকের ৩০ ভাগ পাঠ্যবই ছাপানো হয়েছে বলে জানা গেছে। বইয়ের উত্পাদন থেকে সরবরাহ পর্যন্ত সব কাজ তদারকি করে প্রি-ডিস্ট্রিবিউশন এজেন্ট (পিডিআই)। অন্যদিকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বই সরবরাহের পর, ঐসব বইয়ের মান যাচাইয়ের তদারকি করে পিএলআই এজেন্ট। প্রাথমিকের পিডিআইয়ের কাজ করছে ইনফিনিটি সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন (বিডি)। এর মালিক মো. মনিরের বিরুদ্ধে ছাপাখানার মালিকদের চাপ দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। নিম্নমানের কাগজকে ভালো মানের কাগজের সার্টিফিকেট দিতে প্রত্যেক ছাপাখানার মালিকের কাছ থেকে ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নিচ্ছেন। জনতা প্রেসের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইন্সপেকশন কোম্পানিকে তারা ২ লাখ দিয়েছেন। আরো ৫ লাখ টাকা দাবি করেছে। টাকা না দিলে কাগজের অনুমোদন আটকে রাখা হচ্ছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ইনফিনিটি সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন (বিডি)-এর মালিক মো. মনির ইত্তেফাককে বলেন, ‘জনতা প্রেসের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম কাজলসহ প্রায় ২০টি ছাপাখানার মালিক আমাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছেন, চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু আমি কারো প্রস্তাব গ্রহণ করিনি। কাগজের মানে কোনো আপস করা হচ্ছে না।

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

Developed by: Web Design & IT Company in Bangladesh