মানসিক অবস্থা এবং আমাদের ভুল ধারণা

মাহির বিন সেকান্দার,

  • প্রকাশিত: ১০ অক্টোবর ২০২০, ১১:০১ পূর্বাহ্ণ

প্রায় সময় মানুষ তার মানসিক অবস্থাকে ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করে থাকে। বহুযুগ ধরেই এর ব্যাপকতা গভীর হতে গভীরতর হয়ে চলেছে, এবং ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখছে মানুষ, বিশেষত উপমহাদেশীয় মানুষের মাঝেই এই প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষণীয়।

নিজের মানসিক অবস্থাকে উপস্থাপন করার জন্য মনোবিজ্ঞান হতে মানুষ প্রায় সময় যে জনপ্রিয় অস্ত্রটি ধার করে তার নাম ‘ডিপ্রেশন’। অথচ শতকরা নব্বই ভাগ মানুষই জানে না আসলে ডিপ্রেশন কী, কোন মানসিক অবস্থাকে ডিপ্রেশন বলে আখ্যায়িত করা যায়। স্ট্রেসে থাকা ব্যক্তিও নিজেকে যেমন ডিপ্রেসড জাহির করে আভিজাত্য লাভ করে ঠিক তেমনি অ্যাংজাইটিতে ভোগা লোকটিও ডিপ্রেশনের বিলাসিতা হতে নিজেকে রেহাই দিতে বোধ হয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।

দৈনন্দিন আড্ডার জায়গা হতে শুরু করে করপোরেট লাইফ, ব্যবসা-বাণিজ্য, হাটবাজার সব জায়গায় মানুষের মাঝে যে বাক্যটি সর্বাধিক ব্যবহার হয়ে আসছে তা হয়তো- ‘আমি ডিপ্রেশনে আছি কিংবা আমি অনেক ডিপ্রেসড’। এদের আশি ভাগ লোকেরই জানা নেই তারা ডিপ্রেশনে নেই। ডিপ্রেশনের মতো ভয়ানক মানসিক অবস্থা শখের বসে নিজের ঘাড়ে কেন তারা বহন করে চলে, আমার জানা নেই। তারা হয়তো স্ট্রেসে আছেন কিংবা উদ্বিগ্নতায় ভুগছেন, যা ডিপ্রেশনের তুলনায় অনেকাংশে মাইল্ড।

বেশির ভাগ সময় মানুষ প্রকৃতপক্ষে স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে যায়, আর স্ট্রেসে থাকাকে আমরা মাঝে মাঝে ডিপ্রেশনের নাম দিয়ে থাকি, এটিকে আমি অপরাধ বলতে চাই না, পাপ বললেই বোধ হয় এই ধরনের ভুলের মাশুল আদায় হবে। স্ট্রেস ও ডিপ্রেশনের মাঝে যে ফাইন লাইন চলে গেছে, তার ব্যবচ্ছেদ করে দেখা দরকার। পাঠকের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে তাহলে মানুষ কখনো ডিপ্রেশনে যায়? কখন স্ট্রেসে থাকে? কীভাবে তা বোঝা যায়?

ডিপ্রেশন এবং স্ট্রেসকে আলাদা করে দেখাতে ধার করছি একটি স্ব-অভিজ্ঞতা। কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে এক বন্ধু বললো, ‘আমি ডিপ্রেশনে আছি, আমি এখন কী করব?’ মুচকি হেসে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমনে বুঝলি ডিপ্রেশনে আছিস?’ আমার এমন বেমানান প্রশ্ন অমানবিক মনে হলেও এর পেছনে ছিল যথার্থ কিছু কারণ। প্রথমত আমার ডায়াগনোসিসে সে ব্যক্তি ডিপ্রেসড নয় বরং কিছু স্ট্রেসফুল পরিস্থিতির মধ্যে হয়তো সে আছে। দ্বিতীয়ত, ডিপ্রেসড ব্যক্তি সামাজিক কর্মকাণ্ড হতে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, যদি সে আসলেই ডিপ্রেশনে থাকতো সে অনুষ্ঠানটিতে অংশগ্রহণ করতো না অর্থাৎ সোশ্যাল উইড্রয়াল ডিপ্রেসড ব্যক্তির অন্যতম লক্ষণ।

নিজেকে ডিপ্রেসড বলার আগে নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো (পাঁচ বা ততোধিক লক্ষণ থাকতে হবে) কমপক্ষে দু’সপ্তাহের জন্য আপনার মধ্যে বিরাজমান কি-না তা যাচাই করে নেবেন। এর মধ্যে বিষণ্ন মনোভাব কিংবা অনাগ্রহ ও নিরানন্দ কাজ করা অত্যাবশ্যক।

• প্রতিদিনের বেশির ভাগ সময় ধরে দুঃখবোধ কাজ করা।

• দিনের বেশির ভাগ সময় অনাগ্রহ ও নিরানন্দ কাজ করা।

• ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া।

• ক্লান্তি ও অবসন্নবোধ।

• প্রতিদিন যেকোনো বিষয়ে মনোযোগহীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা।

• নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা, অপরাধবোধ কাজ করা, নিজেকে মূল্যহীন ব্যক্তি ভাবতে শুরু করা।

• অলসতা ও সক্রিয়তা হ্রাস পাওয়া।

• নিজেকে সামাজিকভাবে প্রত্যাহার করা।

উপরিউক্ত লক্ষণগুলো মানসিক পীড়ন তথা স্ট্রেসের সময় দৃষ্টিগোচর হয় না, হলেও তার মাত্রা থাকে খুব ক্ষীণ ও স্বল্পস্থায়ী।

ডিপ্রেশন ও স্ট্রেসের মধ্যে আচরণ ভিত্তিতে আরও কিছু পার্থক্য বেশ লক্ষণীয়। ‘স্লিপিং ক্লক’ ডিপ্রেশন ও স্ট্রেসের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। স্ট্রেসে থাকা ব্যক্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে অন্যদিকে ডিপ্রেশনে থাকা ব্যক্তি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ঘুমোতে পারে আবার কখন কখনো ঘুম নাও হতে পারে। একজন স্ট্রেসড ব্যক্তি তার আসন্ন কিংবা চলমান সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য সর্বদা যেভাবে প্রস্তুত এবং মোটিভেটেড থাকে, একজন ডিপ্রেসড ব্যক্তি আসন্ন বিপদ মোকাবিলায় সেভাবে মোটিভেটেড থাকে না বরং সমস্যা নিরসনে সে যেন এক নীরব উদাসীনতায় ভোগে। যেখানে স্ট্রেসড ব্যক্তি তার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জিং আকারে নেয় সেখানে ডিপ্রেশনে থাকা মানুষটি যেন অবশ অনুভূতির সাগরে সাঁতরাতে থাকে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো পৌনঃপুনিক হারে সুইসাইডাল থটস। সাধারণত স্ট্রেসে এর তুলনায় ডিপ্রেশনে থাকা অবস্থায় আত্মহননের চিন্তা বেশি ঘুরপাক খেতে দেখা যায়।

বলা বাহুল্য, ফিজিওলজিকাল দিক থেকেও যেমন হরমোনের উত্থান-পতন, নিউরাল পাথওয়ে, কেমিক্যাল রিয়্যাকশনসহ বিভিন্ন মেকানিজম স্ট্রেস এবং ডিপ্রেশনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আলোচ্য বিষয় হতে প্রতীয়মান হয় স্ট্রেস আমাদের প্রতিদিনের অংশ হলেও ডিপ্রেশন কোন দৈনন্দিন ব্যাপার নয়।

স্ট্রেসকে আপাতদৃষ্টিতে বিষাক্ত মনে না হলেও কখনো কখনো স্ট্রেস স্লো পয়জনের ভূমিকা পালন করতে পারে। স্থায়িত্বকালের ওপর ভিত্তি করে বিভক্তকৃত অ্যাকিউট (ক্ষনস্থায়ী) এবং ক্রনিক (দীর্ঘস্থায়ী) স্ট্রেসের মধ্যে ক্রনিক স্ট্রেস ডিপ্রেশনের রিস্ক ফেক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে। দীর্ঘদিন যাবৎ অর্থনৈতিক সমস্যা ভোগা, কোনো শারীরিক রোগের জন্য অতিরিক্ত মাত্রায় চিন্তিত থাকা, সন্তানদের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অধিক চিন্তা করা, ইত্যাকার বিষয়াদি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চিন্তামগ্ন থাকা, উদ্বিগ্নতায় ভোগা এসব কিছু দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেসের শ্রেণিভুক্ত। দীর্ঘস্থায়ী এই মানসিক পীড়ন মানুষকে ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দেয়। বলা চলে, ক্রনিক স্ট্রেস ডিপ্রেশনের সিম্পটম আকারে কাজ করে থাকে। আবারও সচেতন করে বলতে চাই কেবল দু একটি সিম্পটম দিয়ে কাউকে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের আওতাভুক্ত করা যায় না।

লেখক: শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ই-মেইল: mbshekander@gmail.com

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...