অগনন প্রাণে আলো জ্বেলেছেন মো. শওকত আলী : সুহৃদ আড্ডায় বক্তারা

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:৫২ অপরাহ্ণ

‘টানা পঞ্চাশ বছর শিক্ষকতার সাথে যুক্ত থেকে শিক্ষাব্রতী শওকত আলী অগনন প্রাণে জ্বেলেছেন আলো, দিকভ্রান্তকে দেখিয়েছেন সঠিক পথের দিশা। মানুষ গড়ার কারিগর হিশেবে তিনি অর্ধশতাব্দির অধিক যে ভূমিকা রেখেছেন তা এক কথায় অতূলনীয়। অনুকরনীয়তো বটেই। নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলিত জীবন এবং সততায় নিবিষ্ট থাকার যে শিক্ষা তিনি দিয়েছেন, তা সমৃদ্ধ আগামী রচনায় রাখছে ভূমিকা।’বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মো. শওকত আলীকে নিয়ে কবিকণ্ঠের সুহৃদ আড্ডায় বক্তরা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন। লন্ডনের কবি নজরুল সেন্টারে ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বসেছিল সুধিজনদের মিলমেলা। উপস্থিত ছিলেন বাঙালি কমিউনিটির কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক এবং সংস্কৃতিকর্মীসহ নানা পেশার গুণীজন। তাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন শওকত আলী। হয়েছেন সকলের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় আপ্লুত।
কবিকণ্ঠের কর্ণধার কবি হামিদ মোহাম্মদের পরিচালনায় এবং চ্যানেল এসের নিউজ প্রেজেন্টার, বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী, লেখক ময়নূর রহমান বাবুল ও টিভি প্রেজেন্টার উর্মি মাজহার। অনুষ্ঠানের শুরুতেই শিক্ষাবিদ শওকত আলীকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করেন ক্ষুদেমনি আফরা খন্দকার ও ইলহাম খন্দকারসহ অন্যান্যরা। অনুষ্ঠানে মানপত্র পাঠ করেন সাংবাদিক ও নারীনেত্রী নিলুফা ইয়াসমীন হাসান এবং তার জীবনী পাঠ করেন কবি সৈয়দ হিলাল সাইফ। অনুষ্ঠানটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন সংস্কৃতিকর্মী ও নাট্য ব্যক্তিত্ব আরিফুর খন্দকার। অপূর্ব শর্মা ও মুনিরা পারভীন সম্পাদিত ‘শিক্ষাব্রতী শওকত আলী’ স্মারক গ্রন্থটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের হাতে তুলে দেয়া হয় l
মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান তার বক্তব্যে বলেন- মোঃ শওকত আলীর মতো শিক্ষক পাওয়া বিরল,তিনি একটানা ৫২ বছর শিক্ষকতা করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন l এই গুণী ব্যক্তিকে অভিবাদন ! বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী শওকত আলীর কাছ থেকে ফার্সী কবিতা শোনার অনুরোধ করলেন lকবি ময়নূর রহমান বলেন, তার চাচা সব সময় দুজন মানুষের কথা বলতেন। এবং অনুপ্রেরণা দিতেন তাদের মত হতে। সে দুজন মানুষ হলেন প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ও মো. শওকত আলী।মো. শওকত আলীর ছাত্র মতিয়ার চৌধুরী আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, আমার প্রিয় শিক্ষককে কাছে পেয়ে তার পা ছুঁয়ে সালাম করেছি, এই সৌভাগ্য আমার কোনদিন হবে তা ভাবতে পারিনি। বিশিষ্ট টিভি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উর্মি মাজহার বলেন, এমন একজন গুণী লোকের সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে আকর্ষণীয় বক্তব্য রাখেন শওকত আলীর সহধর্মিণী শাহানা সুলতানা শেলী। তিনি বলেন, সংসার জীবনে রাগগোসা হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের মাঝেও হতো। তবে, আমি রাগ করলে তিনি রাগ না করে গান বা কবিতা আবৃত্তি জুড়ে দিতেন। কখনো গেয়ে উঠতেন ‘নেশা লাগিল রে বাকা দুনয়নে নেশা লাগিল’ এই অমর গান। কখনো ‘ওগো প্রিয়ে তোমার বিরহে নাহি দহে/ যাহার হৃদয় এতো অন্ধ আঁখি বলো/ কার যে তোমার দেখা নাহি পায়’। অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি মুজিবুল হক মনি। সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকের‘ আমার পরিচয়’ কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী ইয়াসমীন মাহমুদ পলিন।
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর থেকেই শিক্ষাব্রতী মো. শওকত আলীর বক্তব্য শোনার জন্য সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। মো. শওকত আলীর বড় ভাই প্রফেসর মোহাম্মদ আলীরও স্মৃতি উঠে আসে অনেকের আলোচনায়। মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী দুই ভাই ছিলেন কৃতী শিক্ষার্থী ও শিক্ষাবিদ। মোহাম্মদ আলী দুই হাতে এক সাথে সমান তালে লিখতে পারতেন সে কথাটি অনেকটা কিংবদন্তী হিসাবে এখনো বাংলাদেশে চালু রয়েছে। এছাড়া তিনি অলথ্রো ফার্স্ট ক্লাশ অর্জনকারি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ছিলেন। আর শওকত আলী সহস্রাধিক ফার্সী শের, কবিতাসহ গদ্যও অনর্গল মুখস্ত বলতে পারেন। উপস্থিত সুধীজনের বক্তব্যের পরপরই মো. শওকত আলী বক্তব্য দিতে উঠেন। সবাই বসে বলার অনুরোধ করলেও তিনি দাঁড়িয়ে বলতে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ, তিনি সমগ্র শিক্ষকতা জীবনেই দাঁড়িয়ে ক্লাশে বক্তব্য রাখতেন। হেঁটে হেঁটে ক্লাশের চর্তুদিকে ঘুরে ঘু্রে সব ছাত্র তাঁর কথা যাতে মনযোগ সহকারে শুনতে পারে, সে রকম পড়াতেন। সেই অভ্যাসই রয়ে গেছে। তিনি বললেন, আমি যথেষ্ট শক্ত আছি, দাঁড়িয়েই বলবো। তিনি আনুসঙ্গিক বক্তব্য রাখার পরেই আবৃত্তি ও মুখস্ত পাঠ শুরু করেন। প্রথমে ফার্সী কবিতা, এরপর একে একে উর্দু, বাংলা ও ইংরেজী কবিতা ও সংস্কৃত শ্লোক মুখস্ত বলে যান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি আল্লামা ইকবাল, মধুসুদন দত্তর কবিতা, মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু, সুসাহিত্যিক বরকত উল্লা থেকে পাঠ করেন। এক নাগাড়ে তাঁর পাঠ ও আবৃত্তি মুগ্ধ হয়ে শোনেন হলভর্তি শ্রোতৃবৃন্দ। তিনি তাঁর একমাত্র ভগিনী শিক্ষিকা মরিয়ম খাতুন সম্পর্কে বলেন, সুন্দর হাতের লেখার জন্য তখনকার সমগ্র আসামে স্বর্ণপদক পান তিনি। তিনি বলেন, আমরা সুন্দর হাতের লেখার উৎসাহ পেয়েছি তার নিকট থেকে।
অনুষ্ঠানে কবিকণ্ঠের পক্ষ থেকে একটি ক্রেস্ট ও উত্তরীয় প্রদান করে সম্মাননা জানানো হয়। ক্রেস্ট হস্তান্তর ও উত্তরী পরিয়ে দেন কবি নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, কবি হামিদ মোহাম্মদ, আবু মুসা হাসান ও মতিয়ার চৌধুরী। উপস্থিত সুধীজনের মধ্যে উপহার প্রদান করেন বাংলাপোস্ট সম্পাদক ব্যারিস্টার তারেক চৌধুরী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এম এ গণি ও তার গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রীসহ আরো অনেকে।
আড্ডায় আরো উপস্থিত ছিলেন টাউয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক স্পীকার আহবাব হোসেন, রাজনীতিক আঞ্জুমানারা অঞ্জু, শিক্ষাবিদ আবদুল বাসিত চৌধুরী, লেখক আনোয়ার শাহজাহান, কবি মো. মোসাইদ, সংস্কৃকিকর্মী আ ন ম নেসওয়ার, লেখক ও প্রকাশক মোহাম্মদ নওয়াব আলী, ব্রিটিশ বাংলাদেশী টিচার্চ এসোসাসিয়েশনের ট্রেজারার প্রফেসর মিসবাহ কামাল আহমদ, নিউজ প্রেজেনটার মীর আবদুর রহমান, কমিউনিটি নেতা আবদুল বাছির, যুবনেতা জামাল আহমদ খান, সাংবাদিক শাহ বেলাল রহমান, সংস্কৃতিকর্মী নুরুল ইসলাম,নাট্যকর্মী হেলেন ইসলাম, সংবাদ পাঠক লুতফুননেহার বেবী, কমিউনিটি একটিভিস্ট উমা উষা, নাট্যকর্মী শামসুদ্দিন আহমদ, প্রফেসর মিসবাহ, খায়রুজ্জামান সানি, আবৃত্তিশিল্পী শতরুপা চৌধুরী, টিটন শিকদার, শাহ সাদেক মিঠু, লীনা সাদিক ও শাহেদা।
স্বজনদের মধ্যে জুবায়ের আহমদ সুহেল, সাজনা বেগম, সাবিনা সুলতানা জলি, রাসেল আলী, শামীমা নাসরীন পপি, তোফা জামানসহ আরো অনেকে। প্রিণ্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলের ফয়ছল মাহমুদ, মাসুদ আহমদ, কিটন আহমদ। শিক্ষাবিদ শওকত আলীর পুত্র তারেক ইকবাল দীপ, পুত্রবধু নাসরীন সুলতানাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মিডিয়া পার্টনার ছিলেন চ্যালেন এস, এটিএন বাংলা ও এনটিভি।
সবশেষে আপ্যায়নের মাধ্যমে আড্ডার সমাপ্তি টানা হয়। বহুদিন মনে রাখার মত একটি বিরল অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য উপস্থিত সুধীজন ধন্যবাদ দেন কবিকণ্ঠ ও সংশ্লিষ্টদেরকে। উল্লেখ্য, বাচিকশিল্পী মুনিরা পারভীন আড্ডার মধ্যমনি মো. শওকত আলীর জ্যেষ্ঠ কন্যা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার ফাঁকে ফাঁকে মুনিরা পারভীন তার পরিবার থেকে শেখা উদ্দীপনামূলক অনেক গল্প বলেন। এবং জীবনের প্রথম যে কবিতাটি আবৃত্তি করেন, সেটি এক পর্যায়ে পাঠ করে শোনান। মুনিরা পারভীন পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী সুন্দর হাতের লেখার জন্য বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। এছাড়া পারিবারিক ঐতিহ্যই তার বাচিক শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনের প্রধান চালিকাশক্তি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...