চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করে ৯০ ভাগ মানুষ

স্বদেশ বিদেশ ডট কম

  • প্রকাশিত: ২৪ জুলাই ২০২২, ৮:৫১ অপরাহ্ণ

ভুল খাদ্যাভ্যাস, ভেজাল খাদ্যগ্রহণ, জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলার অভাবে বর্তমানে সার্বজনীন স্বাস্থ্যগত সমস্যা গ্যাস্ট্রিক। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে ‘গ্যাসট্রাইটিস’। বর্তমানে খুব কম মানুষ আছেন যাদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নেই। চিকিৎসকদের মতে, আমাদের দেশের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ সরাসরি কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ গ্রহণ করছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই এই সমস্যা মহামারি আকার ধারণ করেছে।

আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির মতে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশই গ্যাসট্রাইটিস সমস্যায় ভুগছেন।

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত পাঁচ বছর ওষুধ বিক্রির শীর্ষ রয়েছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। ২০১৭ সালে যেখানে বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকার ওষুধ, সেখানে সর্বশেষ গত বছর বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে দেশে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।

চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যখন তখন গ্যাস্ট্রিকের ঔষুধ সেবন করার মানে হলো নিজের অজান্তেই শরীরের সর্বনাশ ডেকে আনা। এতে হাড় ক্ষয় থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

বিএসএমএমইউ-এর গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রাজিবুল আলম বলেন, গ্যাস্টিক কথাটা শুদ্ধ কথা নয়। পাকস্থলী সংক্রান্ত যে কোনো অবস্থা বা রোগকে সাধারণত আমরা গ্যাস্ট্রিক বলে থাকি। চিকিৎসকের ভাষায়, পাকস্থলীর আলসার হলে তাকে বলা হয় গ্যাস্ট্রিক আলসার। আবার পাকস্থলীর ক্যান্সার হলে তাকে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার বলে থাকি।

এ রোগের লক্ষণগুলো হলো; পেটের উপরের অংশে ব্যথা বা জ্বালা পোড়া অনুভূত, বুক জ্বালাপোড়া, গ্যাস, বমিভাব, টক ঢেঁকুর, মুখে দুর্গন্ধ, পেট ফাঁপা, ক্ষুধামন্দা, অল্প খেলে ভরপেট অনুভব, ওজন হ্রাস মূলত এসব লক্ষণ প্রকাশ পায়।

অধ্যাপক ডা. রাজিবুল আলম বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার, বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য অভ্যাসের কারণে মূলত এ রোগ হয়ে থাকে। আর এ রোগের অন্যতম কারণ হলো পেটের ভেতর এক ধরনের জীবাণুর প্রবেশ। যেটি পানি বা খাবারের মাধ্যমে পেটে প্রবেশ করে। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র, তাই হাইজিন বা পরিষ্কার পরিছন্নতা খেয়াল করা হয় না। অনেকে খোলা পানি পান বা ওয়াসার পানি সরাসরি পান করে থাকেন। যা জীবাণু মুক্ত নয়। অনেকে হোটেলে বাসি-পঁচা খাবার খেয়ে থাকেন। সঠিক সময়ে খাবার খেতে পারেন না।

এছাড়া অনেকে আছে, হোটেল বা ফাস্ট ফুডের দোকানের খাবার খেয়ে থাকেন, যেখানে দীর্ঘদিনের পোড়া তেল ব্যবহার করা হয়, খাদ্য উপাদানগুলোর সঠিক মান পরীক্ষা করা হয় না। অনেকে ঘরেও অতিরিক্ত তেলেভাজা খাবার বা অতিরিক্ত ঝাল-মসলা জাতীয় খাবার খেয়ে থাকেন। যার ফলে পাকস্থলীর ইনফেকশন দেখা দেয়।

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করলে, শারীরিকভাবে কী কী ক্ষতি হতে পারে এমন প্রশ্নে এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের দেশের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ সরাসরি কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ গ্রহণ করছে। প্রথমত, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ সেবন উচিত নয়। কারণ প্রতিটা ওষুধ কেমিক্যাল প্লান্টের তৈরি করা বস্তু। সুতরাং, কিছু না কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকেই।

স্বল্প মাত্রায় স্বল্প সময়ে হয়তো এটি সমস্যা হয় না। তবে দীর্ঘ সময় এভাবে ওষুধের ব্যবহার করতে থাকলে এটি শরীরে বিভিন্ন রোগ তৈরি করতে পারে। এতে কিডনির ক্ষতি হয়, স্মৃতি লোপ পাওয়া থেকে ডিমেনশিয়া জাতীয় রোগ হতে পারে। এছাড়া সারা পৃথিবীর গবেষণায় এটা প্রামাণিত হচ্ছে যে, দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবনের ফলে গ্যাস্ট্রিকের ক্যান্সার জাতীয় রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

অধ্যাপক ডা. রাজিবুল আলম বলেন, পাকস্থলীর যে এসিড এটা আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ বা জীবাণু প্রতিরোধে অন্যতম একটা উপায় হিসেবে কাজ করে। একজন রোগী যখন খুব বেশি মাত্রায় গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করে তখন এই এসিড ধমন হতে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রোগ জীবাণু পাকস্থলী পার হয়ে ভেতরে ঢুকে যায় এবং পেটের ভেতরে বিভিন্ন ইনফেকশন তৈরি করে।

তিনি বলেন, যারা চিকিৎসক নয়, বিভিন্ন ফার্মেসিতে কাজ করেন বা পল্লী চিকিৎসক রয়েছেন তারা অজ্ঞতাবশত বা ভুল ধারণা থেকে অনেক সময় গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দিয়ে থাকেন। ফলে উপকার না হয়ে ক্ষতি বেশি হয়।

অনেক সময় রোগীরা বলে থাকেন, ডাক্তার সাহেব আমিতো ৪০ পাওয়ারে ওষুধ খাই এতেও গ্যাস কন্ট্রোল হয় না। আমাদের বুঝতে হবে, তার গ্যাস কন্ট্রোল না হওয়ার কারণ এসিডিটি তো নয় বরং অন্য কারণে। সেখানে প্রয়োজন অন্য চিকিৎসা।

অধ্যাপক ডা. রাজিবুল আলম বলেন, পাকস্থলীর গ্যাস্ট্রিক বা আলসার জাতীয় রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে পরিষ্কার-পরিছন্নতা সঙ্গে ফোটানো পানি ছাড়া খাবেন না। এক কথায় বাচঁতে হলে বাইরের খাবার পরিহার করতে হবে। একই সঙ্গে বাসায় অতিরিক্ত মসলাযুক্ত বা তৈলাক্ত খাবার না খাওয়া।

গ্যাস্ট্রিক থেকে বাঁচতে এই চিকিৎসক বলেন, সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ, খালি পেটে চা, কফি গ্রহণ করবেন না। ধুমপান, মাদকদ্রব্য ও অ্যালকোহল বর্জন করুন। যত্রতত্র ব্যথার ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে যা শরীরকে টক্সিন মুক্ত রাখে। ঘুমাতে হবে ঠিকঠাক, মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে। রাতের খাবার ঘুমানোর অন্তত ২ঘন্টা আগে সেরে ফেলুন।

Print This Post Print This Post

এই সম্পর্কিত আরও খবর...